‘সুমন্তর কবিতা নিচুস্বরে বাঁধা। অথচ তাতে ধরা পড়ে সমাজের প্রতিচ্ছবি। তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে আসে রাজনৈতিক পালাবদল, গেরুয়া সরকারের সন্ত্রাস, গুজরাটের গণহত্যা।’ বলছিলেন জয় গোস্বামী। সুমন্ত মুখোপাধ্যায় (Sumanta Mukhopadhyay)। বেথুন কলেজের অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক এবং অতি অবশ্যই ‘শব্দ-সাধক।' গতকাল, ২১ ডিসেম্বর, কলকাতা প্রেসক্লাবে যিনি ভূষিত হলেন, ‘কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কারে’। আয়োজক ‘জন্মদিন পত্রিকা।’ বিগত ২৪ বছর ধরে বহরমপুর থেকে অনিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে ‘জন্মদিন'। এই পত্রিকার সঙ্গে নানাভাবে সঙ্গে জড়িয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আবুল বাশার, কৃষ্ণা বসু, তারাপদ রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা। এবং এই পুরস্কারের বয়সও কুড়ি বছর পেরোল। প্রসঙ্গত, এটি কবি শ্রীজাত-র প্রথম পুরস্কার।
তবে এ-বছর নির্বাচক শ্রী জয় গোস্বামী। তিনিই বেছে নিয়েছেন সুমন্তকে। সুধীন্দ্রনাথের মতোই সুমন্ত অনুবাদক এবং সম্পাদক। সম্পাদনা করেছেন ভাস্কর চক্রবর্তী এবং প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের কবিতাসমগ্র। ‘কালকেতুর শহরে' এবং ‘পোড়ামাটির মুখ' তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। শ্রীগোস্বামীর বয়ানে ‘সুমন্ত সাহিত্যের প্রতি সৎ। তিনি সাময়িক সাহিত্যের থেকে বহুদূরে অবস্থান করেন। তাঁর এক-একটি বই প্রকাশ পায় দশ বছর পরে। নিজের রচনাকে বারংবার ভাঙাগড়ায় তাঁর দ্বিধা নেই।’
সাহিত্যকীর্তির জন্য ‘কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার' ছাড়াও ‘জন্মদিন' আয়োজন করে আরো একটি সম্মাননা। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বিষয়ে ডক্টরেট বিদুষী বেলা ভট্টাচার্যের স্মৃতির উদ্দেশ্যে 'শিক্ষাব্রতী পুরস্কার'। এ-বছর যা তুলে দেওয়া হল বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী, শিক্ষক এবং পশ্চিমবঙ্গ আইনসভার সদস্য শ্রী আশীষ মার্জিতের হাতে। অনগ্রসর শ্রেণির অন্তরে যিনি নীরবে বপন করার চেষ্টা করছেন শিক্ষার বীজ। পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেও লড়ছেন শ্রী মার্জিত। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বেলার সুযোগ্য পুত্র বিখ্যাত সাংবাদিক শ্রী ঋতব্রত ভট্টাচার্য। মায়ের নামে নামাঙ্কিত এই পুরস্কার শ্রী মার্জিতের হাতে তুলে দিতে পেরে আনন্দিত তিনি। এবং ‘জন্মদিনের' এই নিরলস প্রচেষ্টাও তাঁর কাছে পরম গৌরবের।
মঞ্চে ছিলেন আইজুদ্দিন মণ্ডল। মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মানুষটি মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পেরেছেন কেবল। কৃতি ছাত্র হওয়া সত্বেও অভাব কেড়ে নিয়েছিল পড়াশোনার সুযোগ। সেই জেদ থেকেই লড়তে শুরু করেন আইজুদ্দিন। এখন তিনি একটি বি-এড কলেজের সর্বেসর্বা। এবং তাঁরই উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের ট্যাংরামারী গ্রামে পথশিশুদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি কর্পোরেট হোম। যেখানে সেই শিশুদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। বর্তমানে ২৫ জন আবাসিকদের মধ্যে অনেকেই মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে চোখ ধাঁধানো ফল করেছে। নিরলস শিক্ষাব্রতী আইজুদ্দিনও পেলেন বিশেষ সংবর্ধনা। এছাড়া সংবর্ধিত হলেন বিশিষ্ট কবি প্রসূন ভৌমিক এবং বাংলা স্টেটসম্যানের সম্পাদক শ্রীশেখর সেনগুপ্ত। উপস্থিত থাকতে পারেননি বিশিষ্ট অতিথি আব্দুল ওদুদ। প্রতিনিধি মারফত তিনি গ্রহণ করলেন সম্মাননা।
‘আমরা দু-ছত্র লিখেই খবরে চলে আসি। কিন্তু যাঁরা সমাজের জন্য নীরবে কাজ করে যান, তাঁরা আমাদের মতই কবিদের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।’ এ-যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জয় গোস্বামীর এই কথাটির সঙ্গে সহমত ছিলেন না আপাত প্রচারবিমুখ সুমন্ত। জয়ের মত কালজয়ী কবিকে তিনি নিছক কলমচির দলে ফেলেন না। কবিরা ‘সমাজের সহযাত্রী'। তাঁরা রয়েছেন, পরিব্রাজকের মতো। সমাজবিচ্যুত হয়ে নয়, বরং নিবিড়ভাবে সমাজ-পাঠের দর্শনকেই আত্মস্থ করেন তাঁরা।
সুমন্ত একের পর এক পাঠ করে চলেন কবিতা। ধীরে ধীরে থেমে যায় আলগা মুখরতা। শব্দের ঘোর আবিষ্ট করে রাখে শ্রোতাদের…
Powered by Froala Editor