‘আঁধি’র চিত্রনাট্য নিয়ে হাজির হয়েছেন গুলজার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অভিনেত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই সেই অভিনেত্রী বললেন, “আমি কোনো প্রশ্ন করব না। যা বলবেন তা-ই করব।” এরপর শুটিংয়ে যেতেই গুলজারকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে বসলেন উনি। গুলজার তো মহা বিপদে, খানিক লজ্জায়ও। এত বড় একজন স্টার উনি, কি করে স্যার বলছেন! পাল্টা ‘স্যার’ তকমা দিলেন তিনিও। ব্যস, সেই মুহূর্ত থেকে ‘আঁধি’-র প্রতিটা মানুষের কাছে সুচিত্রা সেন হয়ে উঠলেন ‘স্যার’।
বাস্তবিক অর্থেই তিনি ছিলেন ‘দ্য গ্রেট’। শুধু গ্ল্যামারে নয়, নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সেই সময়ের দাপুটে অভিনেতাদের সঙ্গে টক্কর দিতেন তিনি। শুধুমাত্র একটি সময় পর অন্তরালে চলে যাওয়ার জন্যই বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘গ্রেটা গার্বো’ বলা হয় না তাঁকে। ম্যাডাম সেন সবদিক থেকেই ছিলেন সেই ডিভা, যাকে অস্বীকার করা কখনও যাবে না। ফ্লোরে তাঁর গাম্ভীর্য, দাপট তো প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছে। কিন্তু একের পর এক হিট দিয়ে প্রযোজক ও দর্শকদের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সুচিত্রা আসবেন, আর উত্তম আসবেন না, তা কি হয়! বাংলা সিনেমার এভারগ্রিন জুটিকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু শুটিংয়ের বাইরেও তাঁদের যে নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক, সেটা অস্বীকার করার উপায় আছে? সারাজীবনের তুই-তোকারির সম্পর্ক ছিল তাঁদের। এক এক সময় সুচিত্রার সঙ্গে কথায়ও পেরে উঠতেন না তিনি। হয়ত উত্তমকুমার শুটিং করছেন অন্য নায়িকার সঙ্গে, হঠাৎ সেখানে হাজির হলেন সুচিত্রা সেন। শট শেষ হওয়ার পর বলতেন, “কী রে উত্তম নায়িকার সঙ্গে প্রেম হচ্ছে বুঝি?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই ধেয়ে আসত পরের প্রস্তাব - “আমার গাড়ি আছে। চল, কাউকে কিছু না বলে দুজনে ডায়মন্ডহারবার থেকে একটু বেরিয়ে আসি।” উত্তমকুমার ভাবতেন বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে হঠাৎ। সুচিত্রার বদনাম হওয়ার ভয় পেতেন। তা শুনে থোড়াই কেয়ার ‘রমা’র- “একটু বদনাম হোক না। একটু বদনাম হলে তো ভালই হয়। কাগজে বেরোবে যে উত্তমকে নিয়ে পালিয়ে গেছে সুচিত্রা সেন!” এমনই চলত খুনসুটি, আড্ডা। শুধু বাস্তবেই নয়, সিনেমার পর্দাতেও তাঁদের খুনসুটির সাক্ষী থেকেছে দর্শক। মনে পড়ে 'সপ্তপদী'র সেই দৃশ্যগুলির কথা? বিশেষ করে সুচিত্রার সেই ভিন্টেজ ডায়লগ - 'ও আমাকে টাচ্ করবে না।' আর তারপর, ওথেলো-র সেই অভিনয়দৃশ্যে, উত্তম তো তাঁকে ছুঁয়েইছিলেন...
ডেসডিমোনা শুয়ে আছেন বিছানায়, ওথেলো এসে বসল বিছানার পাশে। ডেসডিমোনাকে গলা টিপে হত্যা করতে চায় সে। সেই দৃশ্যে অভিনয় করছিলেন উত্তম-সুচিত্রা। কিন্তু দর্শকদের সিনেমাটি দেখে কখনই মনে হয়নি ওই দৃশ্যের ইংরেজি সংলাপ দুজনের কেউই বলেননি। ওথেলোর সংলাপ বলেছিলেন উৎপল দত্ত এবং ডেসডিমোনার বলেছিলেন জেনিফার। উত্তম-সুচিত্রার কিংবদন্তিসম লিপে এক ফোঁটাও বোঝার জো নেই সেই কথা। সর্বকালের অন্যতম সেরা জুটি হয়ে ওঠার পেছনে যে দুজনেরই যুগ্ম অবদান ছিল, একে অপরের প্রতি সহযোগিতাই ছিল এর ইউএসপি, সেটা বলাই বাহুল্য।
নিজের ভেতর থেকে সেরাটা বের করার জন্য চেষ্টার কোনো খামতি ছিল না সুচিত্রা সেনের। শটের আগে উত্তমকুমারের সঙ্গে বারবার চলত সংলাপ আদান-প্রদান। এতবার কেন জানতে চাইছে রমা? উত্তমকুমারের জিজ্ঞাসায় সুচিত্রার সপাট উত্তর- “তুমি হলে উত্তমকুমার। তোমার ওপর আমাকে টেক্কা মারতে হবে।” আর ডায়লগ ঘুরিয়ে দিলে? সুচিত্রার স্মার্ট জবাব - “সেটা অবশ্য তুই বলতে পারিস। তবে মনে রাখিস গ্রেটা গার্বোর পর আমার নাম,” পরে যে গার্বোর সঙ্গেই যে তোলা হবে তাঁরও নাম, সেটা কি বুঝতে পেরেছিলেন আগেই?
সবসময় মাথা উঁচু করে কাজ করতে হবে- এটাই ছিল তাঁর নীতি। তাই নায়ক সর্বস্ব ইন্ডাস্ট্রিতেও সবার থেকে তাঁর পারিশ্রমিক বেশি থাকত। এমনকি, আরও বেশ কিছু প্রযোজকের ডেট ফেরত হত বলে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজের অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়তি প্রচার থেকে দূরে থাকতেন সবসময়। আজকের সাক্ষাৎকার ও গ্ল্যামার-সর্বস্ব সিনে দুনিয়া দেখলে কি বলতেন বাংলার গার্বো? সে উত্তর আর পাওয়া যাবে না আজ।
ঋণস্বীকার-
১) উত্তমকুমারের প্রিয় তারকারা, সুমন গুপ্ত
২) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘পান্তাভাতে’, গুলজার
৩) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘এলাম দেখলাম চলে গেলাম’, শঙ্করলাল ভট্টাচার্য