প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ! আকাশবাণী থেকে ৬ বছরের জন্য নির্বাসিত সুচিত্রা মিত্র

“পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী”

এক একসময় তাঁকে দেখলে ‘শেষের কবিতা’-র লাবণ্যের কথা মনে পড়ে। তার কোনও সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর গলাতেই ‘কৃষ্ণকলি’-র সঙ্গে পরিচয়, “কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ…”। ওই প্রখর ব্যক্তিত্বের কাছে মাথা নুয়ে আসত অনেকের। ২০১১ সালে থেমে গিয়েছিল সেই আলো। সত্যিই কি একটা মৃত্যু থামিয়ে দিতে পারে সুচিত্রা মিত্র’কে?

সবসময় পথ চলাতেই ছিল তাঁর আনন্দ। হবে নাই বা কেন! চলতে চলতেই যে জন্ম তাঁর। ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, ট্রেনে জন্ম হয় তাঁর। সেই সময় বিহারের গুজন্ডি স্টেশনের কাছে ছিল ট্রেন। সেই থেকে ডাকনাম ‘গজু’। সেই থেকেই তাঁর পথ চলা। বাবা ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। সেখান থেকেই কি রবীন্দ্র ছোঁয়া পেয়েছিলেন সুচিত্রা? সাধনার শুরু কি সেই ছোট্ট থেকেই?

পঙ্কজ মল্লিকের কাছে ছোটবেলায় সঙ্গীত শিক্ষা নিয়েছিলেন। গানই যে হবে তাঁর মন্দির, আর দেবতাটি যে রবীন্দ্রনাথ— বোধ এসেছিল দ্রুতই। বৃত্তি পেয়ে শান্তিনিকেতনে চলে যান। মাত্র কয়েকদিন আগেই মারা গেছেন কবিগুরু। তাঁকে চাক্ষুষ না দেখার আক্ষেপ সুচিত্রা মিত্রের থেকে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন
আকাশবাণীর সম্প্রচারে ‘অচেনা’ সেই রেকর্ডিং-ই; কতটা আলাদা ১৯৬৬-র মহিষাসুরমর্দিনী?

কিন্তু গানের মধ্যে দিয়েই বারবার ছুঁতে চেয়েছেন প্রাণের পুরুষকে। শান্তিনিকেতনে গিয়ে পেলেন ইন্দিরা দেবী, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজানন্দ মজুমদারকে। চার বছরে সঙ্গীতভবনে ডিপ্লোমা শেষ করলেন। পরে স্কটিশ থেকে গ্র্যাজুয়েশন।

আরও পড়ুন
পৌঁছতে পারেননি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, আকাশবাণীতে সেবার স্তোত্রপাঠের দায়িত্বে নাজির আহমদ?

যে সময় সুচিত্রা বড় হচ্ছিলেন, সেই সময় আস্তে আস্তে বাংলায় বাড়ছিল বামপন্থার প্রভাব। সুচিত্রাও সেই ঢেউ থেকে সরে দাঁড়াননি। গণনাট্য সংঘে, রাস্তায়, মিছিলে নেমে পড়েছিলেন। চারপাশের মানুষদের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছেন। ১৯৬০ সাল। দিল্লির আকাশবাণীর লাইভ প্রোগ্রামে বাল্মীকি প্রতিভার জন্য গান গাইছিলেন সুচিত্রা। সেই সময় সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কোনও একটি কারণে, সেখানে কালো পতাকা প্রদর্শন চলছিল। এদিকে সুচিত্রা গাইছেন "কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন, ভাগের বেলায় আসেন আগে"। তারপর হঠাৎই রিপোর্ট গেল, বলা হল সুচিত্রা মিত্র নাকি 'অ্যান্টি-নেহরু'। ছয় বছর আকাশবাণীতে গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেল তাঁর। অবশ্য তাতে পাত্তা দেননি তিনি। সুচিত্রার নিজের কথাতে, "আমি বললাম, আমার বয়েই গেল।"

আরও পড়ুন
মৃত্যুর পরই যেন সম্প্রচারিত হয় এই গান, আকাশবাণীকে নির্দেশ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের

সেকালের আরেক কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে ছিল তাঁর অম্লমধুর সম্পর্ক। পরিচয় সেই আইপিটিএ-র দিনগুলি থেকেই। ১৯৪৩ সালে, অসুস্থ দেবব্রত বিশ্বাস তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন – ‘…এই অসুখের মধ্যে আপনার চিঠিটা ভীষণ ভালো লেগেছে। এবং এত ভীষণ ভালো লেগেছে যে অনেকবার পড়ে ফেলেছি। এবং আমার মনে হছে শরীরটা অসুস্থ না হলে হয়ত আপনার চিঠিটা আরও ভালো লাগত।’

ব্যক্তিজীবনে সুচিত্রা ছিলেন নিয়মনিষ্ঠ, সময় নিয়ে সচেতন। অনুষ্ঠানে হোক বা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত শেখানো— সময়কে নিজের জীবনে প্রচণ্ড গুরুত্ব দিতেন। সেই সঙ্গে ছিল ব্যক্তিত্ব, যার কথা নানা সময় নানা বিশিষ্টজন বলেছেন। সম্মানও পেয়েছেন প্রচুর। পদ্মশ্রী, দেশিকোত্তম, আলাউদ্দিন পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি— লিস্টে নাম অনেক। সেই সঙ্গে পেয়েছেন অগুনতি মানুষের শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম, ভালবাসা। আর পেয়েছেন ‘রবিতীর্থ’ এবং সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের। শান্তিনিকেতনে একটা দীর্ঘ সময় জুড়েও অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। সর্বত্রই রয়ে গেছে তাঁর ছোঁয়া; এমনকি সিনেমার জগতেও। এখন, শুধুই স্মৃতিচারণা। আর অবশ্যই, গান।

ঋণস্বীকার:
১) আনন্দবাজার পত্রিকা বিশেষ বিভাগ, ‘আমার মা যে সুচিত্রা মিত্র, সেটা সে দিন বুঝিনি’
২) আনন্দবাজার পত্রিকা, সম্পাদক সমীপেষু, ‘আলোর ঝর্ণাধারা’
৩। পরবাস, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা

Powered by Froala Editor