সে এক নাম না-জানা হোস্টেল। সেখানে নিত্য নতুন ঘটে চলে দেড়শো মজার কাণ্ড। নন্টে আর ফন্টে নামের দুই বিচ্ছু ছেলেকে শায়েস্তা করতে গিয়ে নিজেই জব্দ হয় কেল্টুদা। আর এই ঘোরতর প্যান্ডিমোনিয়ামে যোগ্য সঙ্গত দেন সুপারিন্টেনডেন্ট স্যার পাতিরাম হাতি। বাঙালি যখন টম এন্ড জেরির নাম অবধি শোনেনি, তখনই কেল্টু কুমারের পিছনে স্যারকে ‘মর্কট’, বিটকেল, ছুঁচো বলে দৌড়াতে দেখেছে। আর এই ক্যাট এন্ড মাউস গেম নন্টে ফন্টের আসল ইউ এস পি।
শুরু থেকে বলি বরং। শুকতারার পাতায় তখন দাপিয়ে রাজত্ব করছে বাঁটুল দি গ্রেট আর হাঁদাভোঁদা। এই জুটি কমেডির সাফল্য দেখে অন্য এক কিশোর পত্রিকা ‘কিশোর ভারতী’ শিল্পী নারায়ণ দেবনাথকে অনুরোধ করেন আর একটি নতুন জুটি তৈরি করার। জুটি তৈরিতে নারায়ণ বাবুর জুড়ি নেই। হাঁদা ভোঁদার পরে দুই দস্যি মেয়েদের নিয়ে শুটকি-মুটকি তাঁরই সৃষ্টি। তিনি রাজি হলেন। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে (অগ্রহায়ণ সংখ্যায়) প্রকাশ পেল দুই কিশোর নন্টে ফন্টের কাহিনি। প্রথমদিকে গল্পের প্লট ছিল একেবারে হাঁদাভোঁদা ধরণের। এঁকে অপরের পিছনে লাগছে। কখনও মিল হচ্ছে, কখনও না। হয়তো এভাবেই চলত, যদি না ১৯৭১ সালে মনোরঞ্জন ঘোষের লেখা ‘পরিবর্তন’ বইটার তৃতীয় সংস্করণের ছবি আঁকার দায়িত্ব নারায়ণ দেবনাথের হাতে পড়ত।
‘পরিবর্তন’ শুরুতে সিনেমা ছিল। মনোরঞ্জন বাবুর গল্প নিয়ে সত্যেন বসু শিশু কিশোরদের জন্য সিনেমাটা বানান। সিনেমা সুপারহিট হয়। সিনেমার সাফল্য দেখে কাহিনিটি বই আকারেও প্রকাশ পায়। সে বই একেবারে সেলিং লাইক হট কচুরিস। বেরোতে না বেরোতে দুটো সংস্করণ শেষ। ১৯৫৪ সালে একই কাহিনি নিয়ে ‘জাগৃতি’ নামের হিন্দি সিনেমাটি মুক্তি পায়। এই সিনেমাটা আমরা কম বেশি সবাই দেখেছি। যারা মনে করতে পারছেন না, তাঁরা ‘দে হামে আজাদি বিনা খড়্গ বিনা ঢাল’ বা’ আও বাচ্চে তুমহে দিখায়ে ঝাঁকি হিন্দুস্থান কি’ গানগুলো মনে করুন। এদিকে তার প্রায় কুড়ি বছর বাদে ১৯৭১ সালে ঠিক হয় ‘পরিবর্তন’ বইটা আবার নতুন চেহারায় ছাপানো হবে। প্রচ্ছদ ও অলংকরণে নারায়ণ দেবনাথ। ছবি আঁকার জন্য বইটা পড়তে গিয়ে নারায়ণ বাবুর মাথায় হাই ভোল্টেজ স্পার্ক! কেমন হবে যদি এই গল্পের মতই নন্টে ফন্টের গল্পও ফাঁদা হয় এক হোস্টেলে! আর সে হোস্টেলেই ঘটবে নিত্য নতুন সব মজার কাণ্ড! যেই ভাবা সেই কাজ। বাড়ি থেকে নন্টে ফন্টে চলল হোস্টেলের পথে। ১৯৭১-এর কিশোর ভারতী পুজো সংখ্যাতেই সে হোস্টেলে এলেন সুপারিন্টেনডেন্ট পাতিরাম হাতি আর তার কিছুদিন বাদেই ওয়ান এন্ড অনলি কেল্টুদা। কেল্টুদা আসার পরেই নন্টে ফন্টে কমিকসের চরিত্র হাঁদা ভোঁদা থেকে একেবারে আলাদা হয়ে গেল। একে একে আসেন পাচক ঠাকুর, গোঁসাইজি, নেংলুকা আর সেই মজাদার গুরুদেব যিনি সাধুভাষায় কথা বলতেন’ আমার আহার্যের নিমিত্ত বাহুল্যের প্রয়োজন নাই। দ্বিপ্রহরে মাংস সহযোগে কিঞ্চিৎ তণ্ডুল সিদ্ধ আর নিশীথে গোদুগ্ধের সঙ্গে কদলী’। এই গুরুদেবকে নন্তে ফন্টে কীভাবে শায়েস্তা করেছিল সে তো সবার মনে আছে।
আরও পড়ুন
অ্যাস্টেরিক্স-স্রষ্টা ইউডেরজো-র আঁকা ছবি নিলামে, অর্থ ব্যয় হবে চিকিৎসার কাজে
ধীরে ধীরে নন্টে ফন্টে কমিকস ম্যাচিওর হওয়া শুরু করে। অসংখ্য হাসির মুহুর্ত, পরিষ্কার ক্লিয়ার লাইন ড্রয়িং, ঝকঝকে ক্যালিগ্রাফির জন্য বাঙালির আদরের চরিত্র হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি এঁদের। আর্জে যেমন তাঁর দুই বিচ্ছু চরিত্র কুইক আর ফ্লুপকি-কে টিনটিনে ক্যামিও প্রবেশ করিয়েছিলেন, ঠিক তেমনটাই করেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। দিলীপ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ব্ল্যাক ডায়মন্ড সিরিজের ‘জীবন দীপ’ কমিকসে গোয়েন্দা ইন্দ্রজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা হয় নন্টে ফন্টে আর কেল্টুর। নন্টে ফন্টের এমনই জনপ্রিয়তা, মাঝে শিল্পী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও অন্য শিল্পীদের দিয়েও নন্টে ফন্টে আঁকানো হয়েছিল কিশোর ভারতীর পাতায়। এঁদের মধ্যে ছিলেন স্বনামধন্য শিল্পী ময়ুখ চৌধুরীও। নন্টে ফন্টের জাদু এমনই।
আরও পড়ুন
৮০ বছর অতিক্রান্ত, নির্বাক হয়েও আজও ‘নতুন’ টম অ্যান্ড জেরি
আসলে নন্টে ফন্টে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার জীবনচিত্র। এর প্যানেলে প্যানেলে জড়িয়ে আছে সেপিয়া টনের নস্টালজিয়া। আটের দশকে কেল্টু ঘরে গান চালায় ‘ডিস্কো দিওয়ানে’ আবার সেই কেল্টুই নতুন শতাব্দীর গোড়ায় ’ছাঁইয়া ছাঁইয়া’ শুনে নাচে। আসে ব্রায়ান লারার কথা (তোদের যে লারা, তাঁকেও আমি গো-হারা করে ছেড়ে দেব), আসে অদ্ভুত সব শব্দবন্ধ (বিটকেল উদুখল, গুঁড়ি দিয়ে মুড়ি থেঁতলানো) আর একেবারে একশো শতাংশ বাঙালিয়ানায় চোবানো অদ্ভুত সব ওনোমাটপিয়া বা প্লুতস্বর (ইঁফ, ভটাস চুলুক, ইরক, গররর, চটাস)। আমাদের অজান্তেই হোস্টেলের ছোকরা দুটো আমাদের মনের বড় কাছের হয় ওঠে।
আরও পড়ুন
নিজে গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্র, টেনিদা’কে টানা সাত বছর ফেল করালেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
এই কমিকস সিরিজের কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ, চিত্ররূপ সবটাই নারায়ণ দেবনাথের একাহাতের তৈরি। গত পঞ্চাশ বছর ধরে নিরলস পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন এঁদের। এমন উদাহরণ সারা পৃথিবীতে আর নেই। কালের গতিতে আজ নন্টে ফন্টে পঞ্চাশ বছরে পা দিয়েছে। প্রকাশ পেয়েছে সুবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যাও। সেটাও নতুন। সারা ভারতের ক্ষেত্রে সেটাও, প্রথম কোনো কমিকস চরিত্রের সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারক সংখ্যা।
তিন প্রজন্মকে এক অদ্ভুত মায়াকাঠিতে আবিষ্ট করে রেখেছেন নারায়ণ দেবনাথ। এখনও তাঁর বই নিয়ে বাড়িতে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। এই আকালে যেখানে ‘প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই ‘সেখানে নন্টে ফন্টের দুনিয়া এক অদ্ভুত জাদুবাস্তবতায় ভর করে আমাদের নিয়ে যায় সব পেয়েছির দেশে। সেখানে এই আকালেও আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি।
Powered by Froala Editor