ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আবহে গম গম করছে নন্দন চত্বর। কেউ সিনেমা হলে ঢোকার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, কেউ আবার নিছকই গল্প করছেন বাইরের চত্বরে। এরই মধ্যে এক বয়স্ক লোক সিনেমা দেখে হল থেকে বেরিয়েই শশব্যস্ত হয়ে লাইন দিচ্ছেন অন্য একটি সিনেমার লাইনে। মুখে লম্বা দাড়ি, মাথার চুল পাট করে আঁচড়ানো, গলায় ডেলিকেট পাশ। আর পাঁচজন দর্শকের থেকে তাঁর গতিবিধি স্পষ্টতই আলাদা। খিদে, তেষ্টার লেশমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁর মধ্যে। বরং, একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক দেশ-বিদেশের সিনেমা গিলে ফেলাই যেন তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য।
আজ থেকে বছর ছয়েক আগেও, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমা দেখার অনন্ত খিদে নিয়ে নিয়মিত এভাবেই হাজির হতেন তিনি। সুব্রত লাহিড়ী (Subrata Lahiri)। নামটা খুব একটা চেনা ঠেকছে না নিশ্চয়ই? সেটাই স্বাভাবিক। ক’জন দর্শক খোঁজ রাখেন সেলুলয়েড পর্দার পিছনে থাকা কলা-কুশলীদের? সিনেমা শেষ হওয়ার পর ক’জনই বা ধৈর্য ধরে পর্দায় চোখ রাখেন ক্রেডিট সিনের সময়? সুব্রত লাহিড়ী তেমনই একজন মানুষ। তাঁর আরেকটা পরিচয়, তিনি সত্যজিৎ রায়ের সহ-পরিচালক। একটি, দুটি চলচ্চিত্র নয়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ থেকে শুরু করে ‘আগন্তুক’— সত্যজিতের অধিকাংশ ছবিতেই সহকারী পরিচালকের ভূমিকা পালন করেছেন সুব্রত লাহিড়ী। কিন্তু নিজে থেকে গেছেন সকলের চোখের আড়ালেই।
দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। বার্ধক্যজনিত অসুখের পাশাপাশি থাবা বসিয়েছিল অ্যালজাইমার ও পার্কিনসন ডিজিজ। দীর্ঘ রোগভোগের পর গতকাল ভোরবেলায় তিনি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। না, তাঁকে নিয়ে কোনো চর্চা হয়নি সেভাবে। হয়নি আলোচনাও। একপ্রকার যেন নীরবেই বিদায় নিলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের পর বার্লিনজয়ী দ্বিতীয় বাঙালি তিনি, প্রয়াত পরিচালক নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়
১৯৩৮ সালে বাংলাদেশের বগুড়াতে জন্ম সুব্রত লাহিড়ীর। তবে বড়ো হয়ে ওঠাও এ-শহরেই। পড়াশোনা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তারপর সেখান থেকেই সোজা হাজিরা দেওয়া সিনেমা পাড়ায়। তাও বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে। তবে খুব কিছু সহজ ছিল না সেই কাজ। সেসময় কলকাতার স্টুডিও-তে টেকনিশিয়ানের কাজ করতে গেলে আগে টেকনিশিয়ান সংগঠনের সদস্য হতে হত। আর সেই সদস্যপদ পাওয়ার পদ্ধতিও ছিল বেশ জটিল। কিন্তু তাঁকে যে আলোকচিত্রী হয়ে উঠতেই হবে। শেষ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায়ের দৌলতে সিনেমার জগতে অভিষেক হল তাঁর। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমাতে। বছর কয়েক আগে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ‘স্পেকট্রাম সত্যজিৎ’ শীর্ষক আলোচনাসভায় এ-কথা নিজেই উল্লেখ করেছিলেন কিংবদন্তি সহকারী পরিচালক ও আলোকচিত্রী।
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায় নামাঙ্কিত চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতে চলেছেন মার্টিন স্করসেস এবং ইসৎভান জাবো
পরবর্তীতে ‘বোম্বাইয়ে বোম্বেটে’, ‘নিশিযাপন’, ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’, ‘গোরস্থানে সাবধান’-সহ সন্দীপ রায়ের একাধিক সিনেমাতেও সহকারী পরিচালকের আসন আলোকিত করেছেন তিনি। পাশাপাশি নিজেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সুব্রত লাহিড়ী। ‘রিঙ্কি অ্যান্ড দ্য প্যারট’-খ্যাত সেই সিনেমার খোঁজ রাখেননি অধিকাংশ মানুষই। এমনকি কোনো আর্কাইভেও সে-সিনেমার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুরূহ।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের লেখা নাটিকা
অসুস্থতার কারণে চলচ্চিত্র-দুনিয়া থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন বছর আটেক আগে। তবে সিনেমার সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ পড়েনি এতটুকু। ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্তও দেশ-বিদেশের সিনেমা দেখতে নিয়মিত হাজিরা দিতেন চলচ্চিত্র উৎসবে। তরুণ পরিচালক ও চলচ্চিত্রকারদের কাছে ছিলেন অভিভাবক-সম।
কিন্তু এমন এক ব্যক্তিত্বের শেষ বয়সটাই হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। স্মৃতিভ্রংশ যার অন্যতম কারণ। পাশাপাশি তাঁর চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেনি সরকারও। পরিচিত মহলের ক’জনই বা খোঁজ রাখতেন তাঁর?
২০২০ সালে বিদায় নিয়েছিলেন সত্যজিতের আরও এক অন্যতম সহকর্মী রমেশ সেন ওরফে পুনু। এবার সুব্রত লাহিড়ীর প্রয়াণে যেন পরিসমাপ্তি ঘটল সোনায় বাঁধানো ‘সত্য-যুগ’-এর…
ছবি ও তথ্য ঋণ— সৌম্যব্রত লাহিড়ী, অভিলাষ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor