বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম পরিচিত মুখ তিনি। মূলত ‘কমেডিয়ান’ হিসাবে পরিচিতি পেলেও, তা একজন অভিনেতার একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠতে পারে না কখনোই। এর আগে স্বভাবসিদ্ধ অভিনয়ে তিনি আমাদের মুগ্ধ করেছিলেন ‘হারবার্ট’-এর মতো সিনেমায়। ২০১৯ সালে আরও একবার সিরিয়াস চরিত্রে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। সিনেমার পর্দায় ফুটিয়ে তলেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রকে। আজ মহালয়া। ভোর থেকেই ঘরে ঘরে বেজে উঠেছে সেই গম্ভীর স্তোত্রপাঠ। দেবীপক্ষের সূচনায় মুখোমুখি বীরেন্দ্রকৃষ্ণে ভদ্রের সেই রূপকার, অভিনেতা শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। আলোচনায় উঠে এল ‘মহালয়া’ ঘিরে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গল্প। শুনলেন তন্ময় ভট্টাচার্য।
প্রথমেই ব্যক্তিগত কৌতূহল থেকে একটা প্রশ্ন রাখি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে আপনার কখনও সাক্ষাৎ হয়েছিল?
শুভাশিসঃ না, ওঁর সঙ্গে কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার আমিও উত্তর কলকাতার ছেলে, আর ওঁর বাড়িও উত্তর কলকাতায়। এবং আমাদের পাড়া দুটো প্রায় মুখোমুখি। মানে গ্রে-স্ট্রিটের ট্রাম লাইনের একপারে ওঁর বাড়ি ছিল শ্যামপুকুর স্ট্রিটের ওখানে রামধন মিত্র লেনে, আর উল্টোপাড়ে আমার বাড়ি দর্জিপাড়ায়। সুতরাং ট্রামলাইনের এপার-ওপার। অথচ ওঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। যখন আমি ওঁর বাড়িটার ব্যাপারে জানতে পারি, তখন প্রায়ই ওঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করতাম, যদি একবার চোখে দেখতে পাই। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, তা কখনও হয়ে ওঠেনি। আমি যে সময়ে আকাশবাণীতে ঢুকেছি, তখন উনি আকাশবাণী থেকে বেরিয়ে গেছেন। কিন্তু আকাশবাণীতে যাতায়াত করতেন মাঝে মাঝে তখন। কিন্তু সেখানেও আমি তাঁকে দেখিনি কোনোদিন।
আপনার বেড়ে ওঠা ষাটের দশকে। আপনার শৈশব, কৈশোরে মহিষাসুরমর্দিনী ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কণ্ঠ দিতেন। আপনার রেডিও শোনার অভিজ্ঞতার সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে আছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ?
শুভাশিসঃ মহালয়ার দিন মহিষাসুরমর্দিনী শোনাই প্রথম স্মৃতি। বলা যায়, কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র সেই সূত্রেই মনের মধ্যে একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন। ছোটো থেকেই মনে হত, কী বেশ একটা শুনছি! কী যেন একটা আবেগ! একটা মূর্ছনা! ইথেরিয়াল অদ্ভুত একটা কণ্ঠ, যেন ঐশ্বরিক কিছু একটা শুনতে পাচ্ছি বলে মনে হত। প্রথমত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এইভাবেই আমার কাছে পরিচিত। নিয়ম করে ভোর চারটের সময়ই রেডিওটা খোলা হত আমার বাড়িতে। আর শুধু আমার নয়, আশেপাশের প্রত্যেকটা বাড়ি থেকেই “আশ্বিনের শারদপ্রাতে...” আওয়াজ পাওয়া যেত। প্রত্যেক বাড়ির ঘরেই রেডিওটা বেজে উঠত একসঙ্গে। আহা! সেটা যে কী অনুভূতি! প্রথাগতভাবে তো পুজোর সাতদিন আগেই মহালয়া। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ এবং এই সমগ্র অনুষ্ঠানটার মধ্যে দিয়েই যেন মনে হত, পুজো এসে গেল। তো এই হচ্ছে আমার বীরেনবাবু সম্পর্কে প্রথম জ্ঞান বা অনুভূতি।
এছাড়াও আকাশবাণীতে বীরেনবাবু বিভিন্ন কথিকা পাঠ করতেন। যেটা টকশো বলা হয়। যার মধ্যে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান ছিল ‘বিরূপাক্ষের আসর’। বিরূপাক্ষের ছদ্মনামে তিনি যে সমস্ত লেখা লিখতেন, সেগুলো পাঠ করতেন আকাশবাণীতে। অসাধারণ সে সব ব্যাঙ্গাত্মক লেখা। সমসাময়িক সময়টাকে ধরে ব্যাঙ্গ করতেন তিনি। পরবর্তী সময়ে আমার কাছে সেটা বীরেনবাবুকে চেনার-জানার একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। বীরেনবাবুর কিছু নাটক, পুরনো নাটক— সেগুলো যখন আকাশবাণীতে সম্প্রচার হত, শুনেছি। ছোটোবেলা থেকেই আমার নাটক শোনার একটা নেশা ছিল। বাড়িতেও নাটক শোনার চল ছিল, আর সেভাবেই আমার ওই অভ্যেসটা হয়ে গেছিল। বীরেনবাবুর নাটকের মধ্যে দিয়েও ওঁকে চিনেছি অনেকটাই। সে যে কী অসাধারণ অভিনয়! এখনও মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে সেই স্মৃতি।
আরও পড়ুন
পৌঁছতে পারেননি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, আকাশবাণীতে সেবার স্তোত্রপাঠের দায়িত্বে নাজির আহমদ?
‘মহালয়া’ চলচ্চিত্রে আপনি যখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেন, আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
শুভাশিসঃ দেখো, বীরেনবাবু হলেন একজন ‘আইকনিক ক্যারেক্টার’। এমন একজন মানুষের চরিত্রে আমি অভিনয় করব, এ তো কল্পনাতীত! যে মুহূর্তে আমাকে পরিচালক সৌমিক সেন ফোন করে বললেন, ‘আমি ছবিটা করছি এবং আপনি বীরেন ভদ্রের চরিত্রে অভিনয় করবেন’, আমি প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। ভাবতেই পারিনি যে আমাকে করতে হবে এই চরিত্রটা! সেই মুহূর্ত থেকে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এটা। যেভাবেই হোক এই চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তুলতেই হবে। হেলা-ফেলা করা যাবে না। এমন চরিত্রও নয় যে কল্পনার রং মিশিয়ে এটাকে সৃষ্টি করব। আমার মনের মণিকোঠায় তিনি যেমন আছেন, তেমনই সারা বিশ্বের যত বাঙালি আছেন, তাঁদের সবার মনের মধ্যে বীরেনবাবু বেঁচে আছেন। ভবিষ্যতেও থাকবেন বলে আমার বিশ্বাস। সেটা একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনই অন্যদিকে হাতে চাঁদ পাওয়া যাকে বলে। সেই মুহূর্তে কী যে হয়েছিল, ওই অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সৌমিক সেন যে তাঁর কল্পনাতে আমাকে এই চরিত্রে ভেবেছেন, আমি তাঁর কাছেও কৃতজ্ঞ। প্রযোজকের কাছেও। প্রসেনজিৎ প্রযোজক ছিল। প্রসেনজিৎ-ও যে ভেবেছে শুভাশিস এই চরিত্রটা করতে পারবে, আমি ওর কাছেও কৃতজ্ঞ।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-কে নিয়ে বাঙালি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এমন সংবেদনশীল একটি চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছিলেন?
আরও পড়ুন
‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে সকলের মধ্যে প্রেম বিলানো একটা বড়ো কাজ’: ইমন
শুভাশিসঃ আমার প্রথম প্রস্তুতি হচ্ছে ওঁর সম্পর্কে কিছু লেখা পড়া। ওঁর সম্পর্কে কোথায় কী বেরিয়েছে সেগুলো খুঁজে খুঁজে পড়লাম। বিরূপাক্ষ ছদ্মনামে ওঁর বেশ কিছু লেখাও পড়া হল। দ্বিতীয়ত, উনি বেতারে কাজ করেছেন এবং বেতারে নাটকের উনি সর্বময় কর্তা ছিলেন। আমি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম, ওঁর সঙ্গে কাজ করেছেন এমন মানুষ কারা আছেন। দেখলাম, বেতারের নাট্যপ্রযোজক অজিত মুখোপাধ্যায় আছেন, নাট্যপ্রযোজক সমরেশ ঘোষ আছেন। এঁদের সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। পাশাপাশি আরেকজন মানুষের সাহায্য পেলাম, যিনি পরবর্তীতে ওই চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি হলেন জগন্নাথ বসু। আমি জগন্নাথদার সঙ্গে যোগাযোগ করতেই উনি একবাক্য বললেন, ‘চলে আয়।’ বীরেনবাবুর ব্যবহার, বীরেনবাবু কীভাবে নস্যি নিতেন, কীভাবে কথা বলতেন সমস্তটাই প্রায় জগন্নাথদা অভিনয় করে দেখিয়ে দিলেন। এবং সবশেষে জগন্নাথদা বললেন ‘বীরেনবাবু কীভাবে হাঁটত জানিস?’ বলে হাঁটাটা পর্যন্ত আমাকে নকল করে দেখিয়ে দিলেন। সেই মুহূর্তে জিজ্ঞে করলাম, ‘তোমার সঙ্গে হাঁটব?’ হাঁটাটাও আমি প্র্যাকটিস করলাম ওঁর সঙ্গে।
বীরেনবাবুর কিছু মুদ্রাদোষ ছিল কথা বলার সময়। যেটা আমি ছবিতে রাখতে পারিনি। কারণ পরিচালক সেটা চাননি বলে। তো সেগুলোও কী ছিল না ছিল, জগন্নাথদা আমাকে বলেছিলেন। এর পর আমি আকাশবাণীর লাইব্রেরিতে গিয়ে বীরেনবাবুর বেশ কিছু নাটক শুনলাম। তার মধ্যে চাণক্য তো ছিলই, তাছাড়া বিরূপাক্ষের কিছু পাঠও ছিল। ছোটোবেলায় এগুলো সবই শুনেছি। পরে বন্ধ হয়ে গেছিল। উনি চলে যাওয়ার পর সুযোগও ছিল না কোনো। আর সেই লেখাগুলোও কেউ পাঠ করেনি। এগুলো থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। শুনে শুনে আবার নিজেকে তৈরি করা গেল আকাশবাণী গিয়ে। এই ছিল তৃতীয়ভাগ। চতুর্থ ভাগ হল, চিত্রনাট্য এবং পরিচালকের ব্রিফ। সেটাই মূল পর্ব। কারণ আমাকে যা করতে হয়েছে তা চিত্রনাট্য পড়েই করতে হয়েছে। যাকে বলে থ্রু টু দ্য টেক্সট। সুতরাং চিত্রনাট্য যেটা বলছে সেটাকে মান্যতা দিয়ে, এবং পরিচালক যেটা চাইছেন সেটার মান্যতা দিয়ে বীরেনবাবুর একটা চরিত্র আমি সাজালাম। সঙ্গে খানিকটা আমার কল্পনা - যে এখানটা এমন হতে পারত, ওখানটা অমন হতে পারত। এইসবটা নিয়ে পরিচালকের নির্দেশ মতো সিনেমায় অভিনয়টা করলাম।
এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করার আগে আপনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে একভাবে চিনতেন। তাঁর চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণ করলেন মানুষটিকে। কতটা নতুন করে আবিষ্কার করলেন ওঁকে?
আরও পড়ুন
বৃষ্টিভেজা শ্রাবণে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ, শেষযাত্রার ধারাবিবরণী দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
শুভাশিসঃ আমি তো শুধু কণ্ঠের ওপরে নির্ভর করে ছিলাম। আর পাঁচজন বাঙালির মতো আমিও তেমন শ্রোতা হিসাবেই ওঁকে চিনে রেখেছিলাম। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে আমার যে তাঁকে বিশ্লেষণ করার জায়গাটা যে পেলাম— ওঁর সম্পর্কে লেখা পড়া, ওঁর কথা শোনা বা এই মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলা। এসব করতে গিয়ে যেটা মনে হয়েছিল, কানে শুনে যে মানুষটাকে আমি ভেবেছিলাম, বাস্তবে তিনি একেবারে ভিন্ন মানুষ। এবং ভীষণ রাশভারী। যেটা তাঁর অভিনয় শুনলে একদমই মনে হয় না। যখন তিনি অভিনয় করছেন বা যখন পাঠ করছেন সেটা অন্যরকম। কিন্তু তিনি যে কী প্রচণ্ড রেগে যেতেন, মানে সাংঘাতিক রাগতে পারতেন, তা জানতে পারলাম।
আমার চরিত্রে একটা জায়গা ছিল – নতুন এক অভিনেতা এসে পাঠ করছে এবং বীরেনবাবু তাকে বোঝাচ্ছেন এখানে এইভাবে অভিনয় করতে হবে; গলাটা আরও তুলতে হবে। উত্তরে ছেলেটি যখন তাঁকে অপমান করছে, আমি যতটা আয়ত্তে রেখেছি রাগটা। বাস্তবে বীরেনবাবু আরও অনেক বেশি ফেটে পড়তেন। এত ফর্সা ছিলেন যে, রাগে লাল হয়ে যেত মুখ। এবং ওঁর গাম্ভীর্য! ভীষণ জোরালো এক ব্যক্তিত্ব। আরেকটা খুব বড়ো জিনিস জানলাম। উনি মেরুদণ্ড সোজা রাখা একজন মানুষ। এটা তো মহিষাসুরমর্দিনী বা নাটকগুলো শুনলে বোঝা যায় না। একজন দুর্বল মানুষও কঠিন চরিত্রের পাঠ করে চলে যেতে পারে। বাস্তবেও মেরুদণ্ড সোজা রাখতেন তিনি। প্রিন্সিপালটা মারাত্মক ছিল। ভীষণ সৎ একজন মানুষ ছিলেন বীরেনবাবু। সে-কারণেই একজন অব্রাহ্মণ স্তোত্রপাঠ করলেও সাধারণ মানুষ সেটা মেনে নিয়েছিল। যদিও একসময় ওঁকে বাদ দেওয়ার কথা উঠেছিল, সেটা রাজনৈতিক দিক থেকেই হোক কিংবা অন্যকিছু হোক। বাণীকুমার বা পঙ্কজ মল্লিক কেউই রাজি হননি। বীরেনবাবুই চালিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা তো একটা বড়ো জয়।
এমন একটা ন্যায়নিষ্ঠ, প্রতিভাশালী মানুষকেই আমি কাজ করতে গিয়ে চিনলাম। যিনি ভীষণ স্নেহপ্রবণ। পরিবারকে, সন্তানদের যে কী ভালোবাসতেন! সবটা ছিল ওঁর মধ্যে। এসবের পরেও কাজপাগল একটা মানুষ। আকাশবাণী ছিল ওঁর ধ্যান, জ্ঞান, প্রাণ সবকিছু। আকাশবাণীর জন্য উনি জীবনপাত করে দিয়েছেন। অথচ শেষ জীবনে আকাশবাণী থেকেই অসম্মানিত হলেন। কী অসম্ভব একটা মানুষের যন্ত্রণা বলো তো। যিনি সৃষ্টি করলেন আকাশবাণীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সেই মানুষটাকেই পরবর্তীকালে অসম্মানিত হতে হয়। সেটা কত বড়ো ধাক্কা, কত বড় কষ্ট! যখন উত্তমকুমারকে আনা হয় ওঁকে সরিয়ে, তখন কিন্তু উনি মেনে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘নতুনরাই তো আসবে। করুক। কেন করবে না?’ উত্তমকুমার ওঁর সঙ্গে বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন। উত্তমকুমারকেও বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি করবে। এত নাম তোমার। আমি বিশ্বাস তুমি ঠিক পারবে।’ উনি কিন্তু এসব শোনার পরে একবারও বলেননি যে উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা করব না। এতটাই অদ্ভুত মানুষ উনি। যিনি এত গাম্ভীর্য নিয়ে থাকেন, এত কঠিন মানুষ কিন্তু তিনি এই ব্যাপারে খুব উদার। তিনি চাইতেন নতুনরা আসুক, নতুনরা কাজ করুক।
১৯৭৬ সাল। তখন আপনার সদ্য যৌবন। অভিনয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে নিয়েছেন নিজেকে সেই বছরটায় যখন উত্তমকুমারের ‘ দেবীং দুর্গতিহারিণীং’ সম্প্রচারিত হল সেট নিশ্চয়ই আপনি শুনেছেন। আপনার নিজের কী প্রতিক্রিয়া ছিল?
শুভাশিসঃ সেটা ঠিক মনে গাঁথেনি। ফলে আমার মনেও নেই এখন। আমি একেবারেই উত্তমকুমারকে অসম্মান করছি না। আমি বিরাট ফ্যান উত্তমকুমারের। ওঁর অভিনয় দেখে বড়ো হয়েছি, শিখেছি অনেক কিছু। আমি মনে করি উনি নিজে একটা ইনস্টিটিউশন। ওঁর অভিনয় ফলো করলে অভিনয়ের একটা পাঠ নিয়ে নেওয়া যায় পুরো। সেই মানুষটা কখনোই ছোটো করছি না। তবে আমার মনে হয়েছিল এই অনুষ্ঠানটার জন্য ওঁকে খুব একটা মনে গাঁথেনি। আর উনি তো পুরোটা করেনওনি। উনি কিছুটা করেছেন। বসন্ত চৌধুরী কিছুটা করেছেন। গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের স্তোত্রপাঠ ছিল। ফলে উত্তমকুমার সেইবার সেইভাবে মনে নাড়া দিতে পারেননি। সামগ্রিক অনুষ্ঠানটাই সেইভাবে দাগ কাটতে পারেনি মানুষের মনে।
বীরেনবাবুর মূল্যায়ন হয়ে গিয়েছিল সেইদিনই। নতুন সেই অনুষ্ঠানকে মানুষ গ্রহণ করেননি এবং আকাশবাণীকে ষষ্ঠীর দিন সকালে বীরেনবাবুর অনুষ্ঠানটি আবার প্রচার করতে হয়েছিল। তো মানুষটার জিত কতখানি, সেখানেই প্রমাণ হয়ে যায়। মানুষ আকাশবাণীতে ভাঙচুর করেছে, গালাগাল দিয়েছে সামনে দিয়ে যেতে যেতে, লোকে বাড়িতে রেগে গিয়ে রেডিওসেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তো এর থেকে বড় জয় কী আর হতে পারে? তবে প্রসঙ্গের বাইরে একটা কথা বলি, জন্মদিনে দু’একটা লেখা ছাড়া বীরেনবাবুর মূল্যায়ন কিন্তু এখনও সেভাবে হয়নি। সেখানে ওই অনুষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা ছিল একটা মূল্যায়নের জায়গা। এবং বহু বছর বাদে এই ‘মহালয়া’ ছবিটা দিয়ে একটা পুনর্মূল্যায়ন করল সৌমিক সেন।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে, মহালয়ার সঙ্গে পরোক্ষে জড়িয়ে গেছেন আপনিও। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে হয়তো বীরেন্দ্রকৃষ্ণের রেফারেন্স হিসাবে উঠে আসবে এই সিনেমাটাও। এই বিষয়টিকে আপনি কেমনভাবে দেখেন?
শুভাশিসঃ আমি সৌভাগ্যবান যে, এই সিনেমাটায় অভিনয় করতে পেরে, এই মানুষটার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। হ্যাঁ, আগামী প্রজন্ম মনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকেই রাখবে। বীরেনবাবুকে মানুষ যতদিন মনে রাখবে, ততদিন আমিও বেঁচে থাকব। যেদিন ওঁকে ভুলে যাবে সেদিন আমাকেও ভুলে যাবে। আমার জন্য এই সিনেমাটাকে মনে রাখবে না। এটা আমার বিশ্বাস। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, মহিষাসুরমর্দিনীর আলোচনায় যদি মহালয়া সিনেমাটার প্রসঙ্গ আসে তবে হয়তো আমাকে মনে রাখবে। তবে যদি ওঁকে কোনোদিন মানুষ ভুলে যান তবে আমার মনে হয় না এই চলচ্চিত্রের জন্য আমাকে আলাদা করে কেউ মনে রাখবে বলে। তবে আমার সার্বিক অভিনয়ের জন্য কতটা মানুষ মনে রাখবেন আমাকে, সেটা সময়ই বলতে পারবে একমাত্র।
এবার নৈর্ব্যক্তিক হয়ে বলুন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে অভিনয় করলেন শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। আপনার কী মনে হয়? ওঁর ব্যক্তিত্বের কতটা কাছাকাছি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন নিজেকে?
শুভাশিসঃ যেহেতু আমি মানুষটাকে চোখে দেখিনি, এই প্রশ্নের উত্তরটা সবথেকে ভাল দেবেন যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, যাঁরা তাঁকে প্রত্যক্ষ দেখেছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন। আবার সেই ইংরাজি কথা, ‘ট্রু টু দ্য ক্যারেকটার’। আমি কতটা সত্যতা বজায় রাখতে পারলাম, বা কতটা কাছাকাছি পৌঁছতে পারলাম। সেই মানুষটা তো হয়ে ওঠা যায় না, কখনোই সেটা হয় না। আমি কতটা তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে পারলাম সেটা বিচার করবে সময়, আর যাঁরা দর্শক তাঁরা বিচার করবেন আমি কতটা ঠিক করলাম, কতটা ভুল করলাম। যদি কিছু করে থাকতে পারি, তাঁর জায়গায় নিজেকে নিয়ে গিয়ে থাকি তবে সেটা আমার কাছে বীরেনবাবুর আশীর্বাদ হয়েই থাকবে।
কোনো অভিনেতা যখন কারোর চরিত্রে অভিনয় করেন, তখন সেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বটিকেও নিজের মধ্যে লালন করেন। ফলে ওই ব্যক্তিরও কিছুটা অংশ ওই অভিনেতার মধ্যেও মিশে যায়। সেই আত্তীকরণের পর্বটা কেমন ছিল?
শুভাশিসঃ সঞ্চারিত মানে ওই যে প্রতিটা মুহূর্তে... ওই মানুষটা তো হয়ে ওঠা যায় না, তবে এই হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হয়। প্রতিটা মুহূর্তে এটা ধরে নিতে হয় আমি এই আইকনিক চরিত্রটাই হয়ে উঠছি। আমি যখন কোনো চরিত্রে অভিনয় করি তখন সেই চরিত্রটা হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। সেই মানুষগুলো সম্পর্কে ভাবি, সেই মানুষগুলো সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি, বুঝতে চেষ্টা করি। অভিনয় করে এলেও আমার মধ্যে ঘুরতে থাকে সেটা। আমি আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, যেকোনো অভিনেতার ক্ষেত্রেই সেটা হয় হয়তো। ওই মানুষটা যেন সবসময় আমার সঙ্গে রয়েছেন। আমার সঙ্গেই কথা বলছেন। আমি যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, কিংবা বসে আছি, তখন ওই মানুষটাকেই আমি ভেবে যাই। সংলাপ নিয়ে যখন বাড়িতে বসে আছি, তখন ওই ছবিটাকেই আঁকবার চেষ্টা করছি। ওই মানুষটার কণ্ঠটা যেন কানের কাছে বাজছে। এটা পরতে পরতে ভেতরে চলতে থাকে। তবেই একটা চরিত্র খাঁটি হয়ে ওঠে।
তবে এই কথাটা শুনে অনেকে বলতে পারে, নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে সারাক্ষণ ওই চরিত্রের মধ্যেই থাকা? না, এমনটা নয়। আমাকে তো দৈনন্দিনের কাজ করতেই হবে, কিন্তু যে মুহূর্তটা আমি ফাঁকা পাচ্ছি, বাড়ি থেকে স্টুডিয়োয় যাচ্ছি, সেই সময়টাতে আমি ওই মানুষটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। অনেকসময় এমনও হয় যে দুটো বা তিনটে ছবির কাজ করছি। তিনদিনে তিনটে ছবির শুটিং করছি। কিছু কিছু চরিত্র হয়, যা গতানুগতিক। কিন্তু যে চরিত্রটা আমাকে ভাবাবে, সেটা নিয়ে প্রতিটা সময় আমাকে অভ্যাস করতে হয়। তবে যে কাজটা করতে যাচ্ছি, সেটাও করতে হচ্ছে। এমন নয় যে সব বাদ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে ওটা নিয়েই ভেবে যাচ্ছি। সেটা হয় না।
যাঁরা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে সামনে থেকে দেখেছেন, আপনার চরিত্রাভিনয় দেখার পরে তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
শুভাশিসঃ জগন্নাথদা, ঊর্মিমালাদি বলেছেন ‘অসাধারণ’। জগন্নাথদা বলেছেন, ‘আমি প্রথমদিন থেকে জানতাম, তুই পারবি। জানতাম তুই ফাটিয়ে দিবি।’ তাঁর খুবই ভালো লেগেছে। আর অন্যান্য মানুষের কথা কী বলব! যাঁরা ওঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁরা বলেছেন। আমার চেহারার সঙ্গে ওঁর একটা মিল রয়েছে সেটাও বলেছেন তাঁরা। আর এর বাইরে খারাপও কারোর কারোর লেগে থাকতে পারে, সেটা তো তাঁরা আমার সামনে হয়তো বলেননি। সেটা আমি জানি না। আসলে এই ব্যাপারগুলো বলা খুব শক্ত। আর এছাড়া আমেরিকার একটা সংস্থা থেকে আমি সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছি।কলকাতার ‘ট্রায়ো’ বলে একটা সংস্থাও আমাকে সম্মানিত করেছিল। জোড়াসাঁকোয় রথীন্দ্র মঞ্চে আমাকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অভিনয়ের জন্য সম্মানিত করা হয়। সেটাও একটা বড় পাওনা আমার কাছে। তাঁদেরও নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল আমার অভিনয়। এই আরকি...
(অনুলিখন – শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়)
Powered by Froala Editor