আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগের ঘটনা। বিছানায় শুয়ে আছেন একজন। হাত-পা কিছুই নড়ছে না তাঁর। ডাক্তারদের মত, মৃত্যু হয়েছে মানুষটার। তারপর? পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক প্লুটার্ক লিখছেন সেই সময়ের বর্ণনা, ‘ওঁর শরীরটা বেশ যত্ন নিয়ে, সুন্দরভাবে রাখা হয়েছিল। এতটুকুও অমর্যাদা করা হয়নি। কিন্তু সেই শরীরে প্রাণের স্পন্দন দেখা দিল না। আগের মতন ধ্বংসাত্মক মেজাজও আর নেই। বরং তা আরও পবিত্র ও সতেজ হয়ে উঠল।’ ধ্বংসাত্মক মেজাজই বটে। একটা সময় গোটা পৃথিবী তাঁর নামে ভয় পেত। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের অন্যতম বীরগাথা তৈরি করে গিয়েছিলেন এই তরুণ রাজা। ইনি আর কেউ নন, গ্রিসের দিগ্বিজয়ী বীর রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট…
ভারতীয়দের কাছে আলেকজান্ডার পরিচিত পুরু’র জন্য। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস দেখলে তাঁকে অস্বীকার করার সাহস কেউ দেখাবে না। একটা সময় গ্রিস থেকে বেরিয়েইছিলেন সমস্ত পৃথিবীটা জয় করবেন বলে। কিন্তু ফিরে যেতে পারেননি। মাত্র ৩২ বছর বয়সে রোগ বিধ্বস্ত হয়ে ব্যাবিলনে মারা যান তিনি। গ্রিসের ইতিহাস পড়তে গিয়ে এই কথা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। যদি আরও কিছু বছর বাঁচতেন, তাহলে কি আবারও পৃথিবী জয় করতে বেরোতেন? অনেক সম্ভাবনা উঠে আসে তর্কে। আর এভাবেই মিথ হয়ে যান আলেকজান্ডার।
তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে ঐতিহাসিকরা নতুন একটি তথ্যের দিকেও নজর দিয়েছেন। যা এক লহমায় চমকে দেয় আমাদের। বহু বছর ধরে ঐতিহাসিকরা আলেকজান্ডারের মৃত্যু রহস্য নিয়ে গবেষণা করছেন। রহস্য? হ্যাঁ, সেরকমটাই মনে করছেন তাঁরা। তবে তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণা সামনে এনেছে অদ্ভুত এক তথ্য। ঐতিহাসিকদের দাবি, আলেকজান্ডারকে হয়তো জীবিত অবস্থাতেই কবর দেওয়া হয়েছিল! তাহলে কি কোনো গোপন ষড়যন্ত্র? আলেকজান্ডারকে থামানোর চেষ্টা?
সেরকম গুপ্তহত্যার কথা অবশ্য বলছেন না তাঁরা। ঐতিহাসিকরা বলছেন, একপ্রকার অজান্তেই হয়তো তাঁকে জীবন্ত অবস্থাতেই কফিনের ভেতর শায়িত করা হয়। তাঁরা দৃষ্টি দিতে বলেছেন একটি বিশেষ রোগের দিকে। খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩২৩ সালে ব্যাবিলনের রাজা দ্বিতীয় নেবুচাডনেজারের কাছে থাকাকালীনই অসুস্থ হয়ে পড়েন আলেকজান্ডার। ধীরে ধীরে অসুস্থতা ও জ্বর বাড়তেই থাকে। সেইসঙ্গে পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা, যেন কেউ বর্শা বিঁধিয়ে দিয়েছে। যত সময় এগোতে লাগল, অবস্থা জটিল হয়ে গেল। একসময় বন্ধ হয়ে গেল কথা, বন্ধ হয়ে গেল নড়াচড়া। চোখের মণিও স্থির হয়ে গেল…
বর্ণনা শুনে মনে হতে পারে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়েছে। ওই সময় উপস্থিত ডাক্তার এবং অন্যান্য মানুষদেরও একই জিনিস মনে হয়েছিল। তাই আলেকজান্ডারকে সমাধিস্থ করেন তাঁরা। এখানেই ঐতিহাসিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন একটি বিশেষ রোগের দিকে। নাম গিলিয়ান-বারে সিনড্রোম (জিবিআর)। এটি একপ্রকার স্নায়বিক রোগ; যেখানে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা সোজা আক্রমণ করে মানুষের নার্ভ সিস্টেমকে। ফলে একটু একটু করে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীর অবশ হয়ে যায়। বলা যেতে পারে, একপ্রকার কোমার পরিস্থিতিতে চলে যায় শরীর। কিন্তু সেটা মানেই মৃত্যু, এমনটা নয়।
হয়ত আলেকজান্ডারের এই একই অসুখ হয়েছিল। এই স্নায়বিক রোগের জন্য দায়ী ক্যামপাইলোব্যাকটর পাইলোরি নামের এক ব্যাকটেরিয়া। সম্ভবত এতেই আক্রান্ত হয়েছিলেন আলেকজান্ডার। তাই শরীর কোমায় চলে গেলেও, প্রাণ যায়নি তাঁর। আর সেটা বুঝতেই ভুল হয়েছিল বাকিদের। তাই জীবিত অবস্থাতেই হয়ত সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেই সময়ের অন্যতম চর্চিত ব্যক্তিত্বকে। প্রাচীন সময়ের বেশ কিছু ঐতিহাসিক আবার বিষপ্রয়োগে মৃত্যুর কথাটিও তুলে এনেছেন। সবথেকে প্রচলিত মত ছিল ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু। কিন্তু সত্যিই কি তাই হয়েছিল? এই সব উত্তর লুকিয়ে আছে আলেকজান্ডারের কবরে। কিন্তু এখানেও আরেক আশ্চর্য। আজ পর্যন্ত তাঁর সমাধিস্থল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক জায়গায় ধারণা করা হয়েছে বটে, কিন্তু সেরকম কিছু সামনে আসেনি। ব্যাবিলন, ম্যাসিডোনিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া তো বটেই, আরও বহু জায়গায় ঐতিহাসিকরা পৌঁছে গেছেন। আজও খোঁজ চলছে তাঁর। আলেকজান্ডার যে গ্রিক বীর! এত সহজে কি তিনি সামনে আসবেন…
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম ইসলাম সমাধি ‘বাংলার যুবরাজে’র, স্থানীয় অধিবাসীরা সিন্নি চড়ান আজও
Powered by Froala Editor