Cannes-এর দরজা ঠেলে: রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীরা, আর্তি সিনেমা দেখার

‘একটা টিকিট দিলে আপনাকে একটা গান শোনাতে পারি...’

এই লাইন লেখা কাগজ হাতে ছেলেটাকে রোজই ‘প্যালে দে ফেস্টিভাল’-এর উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। প্ল্যাকার্ডের লেখায় কেবল সিনেমার নামটা বদলে যায় রোজ। একটা ঝকঝকে লাল সানগ্লাস চোখে স্যুটেড-ব্যুটেড ফুটফুটে ছেলে। আজ আর লোভ সামলাতে না পেরে আলাপ জমিয়ে ফেললাম। ‘আই অ্যাম মার্স, ইউ নো, লাইক দা প্ল্যানেট!’ বলেই হো হো করে হেসে উঠল ছেলেটি। আমিও হাসি চাপতে পারলাম না। ফ্রান্সের এক্কেবারে উত্তরে ফিল্ম স্টাডিজ-এর ছাত্রটি বছরের এই সময়টা দিন চারেক এইভাবেই কাটায়। ছাত্রাবস্থায় পকেটের টাকা থেকে বাঁচিয়ে বাস-ট্রেন পাল্টে এখানে আসে। এক বন্ধুর সোফায় ঘুমিয়ে সকাল থেকে প্ল্যাকার্ড হাতে অপেক্ষা, যদি একটা সিনেমার নিমন্ত্রণ কেউ জোগাড় করে দেন! এবারের উৎসবে মার্স অবশ্য এখনও অবধি একটাই সিনেমা দেখার সুযোগ পেয়েছে।

৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে (Cannes Film Festival) এ এক চিরায়ত চিত্র। প্রথম দিন থেকেই লক্ষ করেছি, মূল লুমিয়ের প্রেক্ষাগৃহে যে-কোনো সিনেমার প্রথম স্ক্রিনিং বা প্রিমিয়ারের আগে, হলের প্রবেশপথের আশেপাশে মার্সের মতোই বহু যুবক-যুবতী সেজেগুজে এমনই নানা প্ল্যাকার্ড হাতে অপেক্ষায় থাকে। আসলে উৎসব কমিটি ২৮ বছরের কম বয়সিদের জন্য ৩ দিনের একটা পাসের ব্যবস্থা করে থাকে— অবশ্য সে-পাস পেতে হলে কোনো-না-কোনো বিখ্যাত ফিল্ম-ক্লাবের সদস্য হতে হবে আপনাকে। জমা পড়া হাজারো আবেদনের মাঝে পছন্দসই প্রার্থীদের দলে দলে ভাগ করে ৩ দিনের কার্ড দেন কর্তৃপক্ষ। সমস্যা হল, এই কার্ড পেলেও সাংবাদিক বা চলচ্চিত্র জগতের পেশাদার মানুষদের মতো ওয়েবসাইটে ঢুকে পছন্দমতো সিনেমার ছবির পাস জোগাড় করার সুযোগ থাকে না ছাত্রছাত্রীদের।

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ফরাসি সিনেমা, শিল্পীর আত্মানুসন্ধান ও অস্তিত্ব-সংকট

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: বিধ্বস্ত ইউক্রেন, প্রতিবাদী ক্যামেরা ও এক আতঙ্কিত মায়ের গল্প

এই সমস্যার কথাই জানালেন গ্রিসে ফিল্ম-স্টাডিজ পড়া তেইশ বছর বয়সি সোফিয়া। কান-এর খটখটে রোদেও ঝকঝকে হাসিতে খামতি নেই মেয়ের। ঘামতে ঘামতে হাতের প্ল্যাকার্ড সামলে নিয়ে বললেন, ‘আগের বছর আমার কাছে একটা টিকিট ছিল। এই প্রথম আমি এই পদ্ধতিতে টিকিট খুঁজছি।’ সব মিলিয়ে মোট তিনটে প্লেন পাল্টে আজই চলচিত্র উৎসবে এসে পৌঁছনো সোফিয়া আরও জানালেন, ‘আমি আবার সেই জমজমাট প্রেক্ষাগৃহে সিনেমার পরিচালক আর তাঁর গোটা টিমের সঙ্গে বসে একটা ছবির প্রিমিয়ার উপভোগ করার অভিজ্ঞতায় ফিরে যেতে চাই। সে-অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা নেই! আপনার কাছে একটা টিকিট আছে?’ বেচারির বিমর্ষ মুখে তখনও হাসি ফুটে থাকে। যতটা সম্ভব নম্রতা বজায় রেখে, টিকিটের ব্যবস্থা যে আমিও করতে পারব না, তা জানিয়ে নিজের প্রেস কার্ডের জোরে মূল প্রেক্ষাগৃহের রাস্তায় ঢুকে পড়ি।

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ছবিতে-গল্পে ‘অদেখা’ চলচ্চিত্র উৎসব

রেড কার্পেটের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে যায় নিজের কলেজ-ইউনিভার্সিটি জীবনের সিনেমা-উন্মাদনার কথা। মনে পড়ে, কীভাবে কেবল কলকাতা ইউনিভার্সিটির কার্ড দেখিয়ে দু-একটা সিগারেট ঘুষ দিয়ে দারোয়ান কাকুদের দৌলতে নন্দন, রবীন্দ্রসদনের মেঝের কার্পেটে বসে একের পর এক সিনেমা দেখেছি বন্ধুবান্ধবরা। এখন মাঝবয়সের দোড়গোড়ায় এসে মার্স, সোফিয়াদের দিকে তাকিয়ে বারবার নিজেকেই দেখি আমি। ধ্বংসের মুখে এনে ফেলা সিস্টেমের জাঁতাকল ওদের এখনও ছুঁতে পারেনি। আমরা যারা রাজনীতি, ধর্ম, একচিলতে বাঁচতে চাওয়ার খেয়োখেয়ির মধ্যে নিজেদের অজান্তেই গুঁড়িয়ে যাচ্ছি, সোফিয়াদের হাসিই পারে আমাদের জং-ধরা সৃজনশীলতায় প্রেমের প্রলেপ লাগাতে। সিনেমাই পারে এক সার্বিক গৃহযুদ্ধে পরিণত হওয়া আমাদের আজকের অজানা পৃথিবীকে আবার শৃঙ্খলহীনতার আকাশ ফিরিয়ে দিতে। 

এভাবেই প্রতিটি মোড়ে এমনই নানান মানবিকতায় মোড়া গল্প নিয়ে অপেক্ষায় থাকে কান চলচ্চিত্র উৎসব, যার দৌলতে আমি আবারও রাস্তায় নেমে প্রাণপনে জীবনকে বুঝে নিতে পারছি!

Powered by Froala Editor

More From Author See More