মুসলমানের দোকান থেকে বিস্কুট কেনা ‘অপরাধ’, ছাত্রদের নিন্দায় মুখর বঙ্গসমাজ

একজন হিন্দু ব্যক্তি একটি দোকানে ঢুকে বিস্কুট কিনলেন। ঘটনাচক্রে, দোকানি একজন মুসলমান। এক মুসলমানের দোকানে ঢুকে এক হিন্দু বিস্কুট কিনছেন— এমন ঘটনা আজকের অসহিষ্ণু ভারতে ঘটলেও কেউ আমল দেবে না। এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার! তবে এই স্বাভাবিক ব্যাপারই একটা সময় কল্পনাতীত ছিল। আজ থেকে প্রায় ১৯০ বছর আগে ঘটে যাওয়া এমনই একটি ঘটনা ঘিরে তোলপাড় হয়েছিল কলকাতা।

১৮৩০ সালের মার্চে সমাচার দর্পণ পত্রিকায় এই খবর বেরিয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল— “জ্ঞাত হওয়া গেল যে হিন্দু কালেজের একজন ছাত্র মুসলমান রুটিওয়ালার দোকানের নিকট দিয়া গমন করত ওই দোকান ঘরে প্রবেশপূর্ব্বক এক বিস্কুট ক্রয় করিয়া ভক্ষণ করেন।” ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন পড়ে গেল সমাজে। যতই বিস্কুট হোক, বেজাতের দোকানে ঢুকেছে এবং খেয়েওছে! ছাত্রসমাজের এতটা ‘অধঃপতন’ আশা করেননি সেকালের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ। অবশ্য এই মানসিকতায় ধাক্কা দেওয়াই তো ওই ছাত্রদের কাজ ছিল। তাঁরা যে স্বয়ং ডিরোজিও’র শিষ্য, ইয়ং বেঙ্গলের সদস্য।

এই ঘটনার খুব বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে রাজনারায়ণ বসুর ‘সেকাল আর একাল’ বইতে কিছুটা বিবরণ রয়েছে। সেই সময় সমাজের সমস্ত কুসংস্কারগুলোকে এক এক করে ভেঙে ফেলতে বদ্ধপরিকর ডিরোজিও’র ছাত্ররা। সেজন্য পরিবার-পরিজন, সমাজ সমস্ত জায়গা থেকেই আঘাত আসতে থাকে তাঁদের ওপর। কিন্তু দমে যাননি। এই পরিকল্পনারই একটি অংশ ছিল এই বিস্কুট কেনা। প্রথমে অবশ্য কে কিনতে যাবে, কীভাবে কাজটি হবে— তা নিয়ে ছিল সংশয়। একজন মুসলিম রুটি বিক্রেতার দোকানের সামনে এলেনও, কিন্তু সাহস করতে পারছিলেন না অনেকে। তারপর একজন ভেতরে যায়, কিছুক্ষণ পর বিস্কুট কিনে বেরিয়ে আসে। এরপর সমস্ত আগল ভেঙে যায়। বাকিরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল “Hip! Hip! Hurrah!”

এই ঘটনা নিয়েই দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেল বঙ্গ সমাজ। একদল রীতিমত ছাত্রদের তুলোধোনা করতে ব্যস্ত। আরেক দল ছাত্রদের পাশেই এসে দাঁড়ালেন। তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দুদের পত্রিকা ‘সমাচার চন্দ্রিকা’-য় তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করা হল। আরও নানা পত্রিকা সেই সঙ্গে যোগ দিলেন। কিন্তু ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে সমান তালে লড়ে গেল ‘সম্বাদ কৌমুদী’। অবশ্য এই সামান্য ঘটনা নিয়ে এত তরজার প্রতিবাদও করেছিল ‘সমাচার দর্পণ’। তাঁরা লেখেন, “আবশ্যক সম্বাদের অভাবে যে এক ক্ষুদ্র ঘটনাতে চন্দ্রিকাকার ও কৌমুদী-কারের মধ্যে বৃহদঘটনাঘটিত দুই কাব্য উত্থিত হইয়াছে তদ্বিষয়ে আমরা কিঞ্চিৎ প্রকাশ করিলাম।” তবে এই ঘটনায় যে ছেলেটি ভেতরে ঢুকেছিল, তাঁর পরিচয় পরবর্তীকালে পাওয়া যায় না। সে অজ্ঞাতবাসেই থেকে গেছে।

তবে যত ছোটো ঘটনাই হোক, এই ঘটনাগুলো থেকেই যে সমাজ বদলের একটা সূচনা হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। আর সেটা করেছিল শিক্ষিত সমাজ, ছাত্ররা। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই ঘটনার সঙ্গে মিল পেতেই পারেন আপনি। তফাৎ একটাই, আজকের ঘটনাগুলোয় বিস্কুট নেই। ধর্মকে কেন্দ্র করে এমন হানাহানি, বিদ্রোহ, সংবাদমাধ্যমের পারস্পরিক আক্রমণ, সেই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ছাত্রসমাজই জেগে উঠছে। এই জায়গায় ১৮৩০ আর ২০২০ একই জায়গায় এসে মিলেছে।

Powered by Froala Editor