বাংলাদেশ তখনও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে ওঠেনি। আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে তখন উত্তাল পূর্ব পাকিস্তান। সেটা ১৯৬৮ সাল। ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' শুরু করলেন আইয়ুব খান। সেইসঙ্গে, সামরিক বাহিনী নামিয়ে দখল করলেন ঢাকা শহরের সমস্ত রাজপথ। এমনকি বাংলাদেশের অন্যান্য সমস্ত অঞ্চল, যেখানে যেখানে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল। আন্দোলন সাময়িকভাবে পিছু হটলেও, ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগেনি।
১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার নিচে জড়ো হয় ছাত্রসংগঠনগুলি। ১১ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় সেই সমাবেশ থেকে। তারপর শুরু হয় এক রক্তক্ষয়ী পথচলা। আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। নেতৃত্বে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ।
১৭ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার হওয়ার দিনটিকে মাথায় রেখেই আন্দোলন শুরু হল। ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নামল ঢাকার মানুষ। নেতৃত্বে ছাত্ররা। ১৮ জানুয়ারি সাধারণ মানুষের মিছিলের উপর গুলি চালায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। আসাদের রক্তমাখা জামাকে পতাকা বানিয়ে নতুন করে শপথ নিলেন বাংলাদেশের মানুষ।
আরও পড়ুন
স্বাধীনতার জন্য তুলে নিয়েছিলেন বন্দুক, আজ জুতো সেলাই করে পেট চালান মুক্তিযোদ্ধা
আসাদের মৃত্যুর প্রতিবাদে আবার নতুন করে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। দলে দলে যোগ দেয় স্কুল কলেজের পড়ুয়া থেকে শ্রমিক, কৃষক অথবা সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ। ২১ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে হরতাল শুরু হয়ে গেল। ২২ থেকে ২৪ - তিনদিন লাগাতার চলল হরতাল। ২২ তারিখ ঢাকা শহরের সমস্ত বাড়ির মাথায় উড়ল কালো পতাকা। ২৩ তারিখ সন্ধ্যার পর বেরোল মশাল মিছিল। পরদিনের 'আজাদ' পত্রিকার শিরোনাম ছিল, 'স্মরণকালের বৃহত্তম মশাল মিছিল'।
এরপর ২৪ তারিখের হরতাল সমস্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কাতারে কাতারে মানুষ ঘিরে ফেলে পল্টন অঞ্চল। সমস্ত মিছিলের নেতৃত্বে কিশোর ছাত্ররা। নির্বিচারে গুলি চালায় সেনাবাহিনী। বহু ছাত্র সেদিন মারা গিয়েছিল। মতিউর, মকবুল, রুস্তম ও আলমগীরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। সেই খবর ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার প্রায় প্রতিটা মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসে।
২৪ তারিখের সেই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। সাধারণ পড়ুয়াদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ইতিহাস চিরদিন মনে রাখবে। কিন্তু এসবের মধ্যে একটি শিশুর কথা প্রায় অনালোচিতই থেকে যায়।
ফটোগ্রাফার রশিদ তালুকদারের ক্যামেরায় সেদিনের অনেক ছবি স্মৃতি হয়ে থেকে গেছে। তারই মধ্যে একটি ছবিতে দেখা যায় মিছিলের পুরোভাগে এক নাবালক শিশু। তার স্লোগানে গলা মেলাচ্ছে জনতা। একটি ছবি তোলার পর আরেকটি ছবি তুলতে রিল টানেন রশিদ তালুকদার। কিন্তু ততক্ষণে সেনাবাহিনীর গুলিতে তার দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর পাকিস্তানের নাম মুছল বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ত্রিশ লক্ষ শহীদের একজন ওই শিশুটি। তার নাম জানা যায়নি কোথাও। তার কথা সচরাচর আলোচনার বাইরেই থেকে যায়। অথচ ওই সামান্য বয়সেই দেশের প্রতি কী অদ্ভুত আকর্ষণে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে পেরেছিল ছেলেটি!
অবাক লাগে আজও ছবিটি দেখলে। হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব সে পাবে না কোনোদিনই। হয়তো অজান্তেই জড়িয়ে পড়েছিল মিছিলে। সম্ভাবনা অনেক, সত্য একটাই। মৃত্যু। স্থিরচিত্র যাকে অমর করে রেখেছে…