শাহবাগ চত্বর থেকে ভিড়টা গোল করে ঘুরে গেছে বাঁদিকে। শুক্রবারের দুপুর। একে ছুটির দিন, তার ওপর একুশের বইমেলা। ঢাকা জুড়েই একটা উৎসবের মেজাজ। দিকে দিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের হোর্ডিং। কোথাও কোথাও ইলেকট্রনিক বোর্ডে অপেক্ষার কাউন্টিং চলছে। ঠিক কত দিন, কত ঘণ্টা, কত মিনিট বাকি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের। ফুটপাতে ফুল দিয়ে মুকুট তৈরি করছেন কয়েকজন মহিলা। অনেকটা পাতা দিয়ে তৈরি গ্রিক মুকুটের মতো। শুধু এখানে ফুল বেশি, রং বেশি। মিলাদ বলছিল, ঢাকার মেজাজ এমন থাকলে কুখ্যাত জ্যামকেও আর অসহ্য লাগে না। কার্জন হলের সামনে দাঁড়িয়ে মিল্কমেইড আর আদা দিয়ে বানানো চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঢাকার প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম।
এই গল্প যখন শুরু হচ্ছে করোনা আতঙ্ক তখনও দু’দেশের সীমানা ‘সিল’ করে দেয়নি। ঢাকাতেও অবাধ চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা চাপেনি। মুখোশ কিংবা স্যানিটাইজারের প্রকোপ শুরু হয়নি। দিব্বি মালাই চা কিংবা বাখরখানি চাখতে চাখতেই এগোনো যাচ্ছিল ভিড় ঠেলে। ফুটপাতে বেলুন-ওয়ালা, ঝালমুড়ি, চৌখুপি কাচের বাক্সগাড়িতে মিঠাই। মাঝে মাঝেই অন্তত কিলোমিটার খানেক জুড়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। এই অবস্থাতেই একটা রিক্সায় দু’জন এসে উঠলেন। দরদাম হল। ওঠার পরে রিক্সা একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। নড়ার উপায় নেই। সেই দম্পতি যদিও স্থির রিক্সায় উঠেই খুশি। তাদের খোশগল্পে কোনো বিরক্তি নেই। মিলাদ ঠিকই বলছিল, ঢাকার অগাধ সময়।
প্রজন্ম চত্বরের দিকে গাড়িটা বাঁক নিতেই চোখে পড়ছিল সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে। আর ফুটপাত জুড়ে কিচিরমিচির করে হল্লায় মেতেছে একরাশ ছাত্রী। অনেকের মাথায় লাল-সবুজ টুপি। তাতে লেখা ‘বঙ্গবন্ধুর চেতনা নবীনের প্রেরণা’। কারো কারো মাথায় সেই ফুলের মুকুট। কলকাতা থেকে এসেছি শুনেই ঘিরে আবদার শুরু হল। “একখান ছবি তুলে দ্যান চাচা।” ছবি তোলার পর্ব দীর্ঘায়িত হতেই থাকে।
তারই মধ্যে শুরু হল কথাবার্তা। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর চেতনা বলতে ঠিক কী বোঝায়? ক্লাস এইট, নাইনের ছাত্রীদের চোখ বঙ্গবন্ধুর নাম শুনতেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। “উনি আমাদের জাতির জনক।” কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের অবদানের কথাও বলতে থাকে স্রোতের মতো।
এরপরের গন্তব্য বইমেলা। পাশ দিয়ে যাওয়া বাস থেকে তখনো হাত নাড়ছে উচ্ছ্বল কিশোরীদের ঝাঁক। “লেখা উঠলে পাঠাবেন তো?” জনে জনে আশ্বাস দিই। একপাশে গেটে লেখা ‘মুক্তির উৎসব ২০২০’। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক তরুণী সেলফি তুলছে। কেউ বা চুমুক দিচ্ছে বেলের সরবতে।
ইতিহাস ভোলেনি বাংলাদেশ। ঢাকা জুড়ে তাই বঙ্গবন্ধু উজ্জ্বল হয়ে আছেন। ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে আজও ভিড় জমায় নতুন প্রজন্ম। বাসার সামনে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে হাতির ঝিল ধরে বেঁকে যায় ভিড়। শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু ছিলেন এই বাসায়। এখানে দেওয়ালে আজো লেগে রক্তের দাগ, বুলেটের চিহ্ন। নতুন প্রজন্মের বুকে সেই ক্ষত হয়তো জমাট বেঁধে নেই, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন।
আজ, ১৭ মার্চ। করোনার আতঙ্ক থাবা না বসালে গোটা বাংলাদেশ আজ মেতে উঠত উৎসবে। ফের হয়তো রাজপথে ঢল নামত তরুণ-তরুণীদের। অপেক্ষা দীর্ঘতর হত রাস্তায় আটকে পড়া যাত্রীদের। তাতে অবশ্য বিরক্তি বাড়ত না ঢাকার। মিলাদ বলছিল, ঢাকার অপেক্ষার জোর বোঝা মুশকিল, তার বাহারি মেজাজের তল পাওয়াও সহজ নয়। কল্লোলিনী তিলোত্তমা থেকে উজিয়ে গিয়ে সেই মেজাজের আঁচ অবশ্য পেয়েছিলাম আমরা। সেই মেজাজে চিরবসন্ত…
এ ঢাকার প্রেমে না পড়ে উপায় নেই।