পিতা আশুতোষ সেনের ইচ্ছা ছিল না ছেলেকে শান্তিনিকেতনে (Santiniketan) পড়তে পাঠানোর। শ্বশুরমশাই ক্ষিতিমোহন সেনের তত্ত্বাবধানে রাখার বদলে চেয়েছিলেন ঢাকার ‘জগৎ কুটীর’-এ নিজের কাছে রেখে পড়াশোনা করাতে। কিন্তু জেদ ধরে বসলেন স্ত্রী অমিতা সেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে তাঁর। পুত্র অমর্ত্যের নামও রেখেছিলেন কবিগুরু স্বয়ং। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ছেলেকে বিশ্বভারতীকে পাঠানোর আকাঙ্ক্ষা আরো জোরদার হয়ে ওঠে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ঢাকায় জাপানি আক্রমণের ভয় নেহাত অমূলক ছিল না। সব দিক বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে অমর্ত্য সেন (Amartya Sen) পাড়ি দিলেন শান্তিনিকেতনের পথে। মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেনের কাছে তা ছিল অমর্ত্যের ‘ঘরে ফেরা’।
সেই ঘরেই তিনি পেলেন সমগ্র বিশ্বের আস্বাদন। রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত শিক্ষার ছায়ায় ধীরে ধীরে তৈরি হল তাঁর পরিপূর্ণ সত্তা। পরবর্তীতে যেভাবে অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং মানবতার বিস্তৃত প্রান্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজস্ব পরিচয়, তার বুনিয়াদি শিক্ষা শুরু হয়েছিল এখানেই। ধরাবাঁধা শিক্ষার পাঠ অতিক্রম করে সন্ধান পেয়েছিলেন মুক্তচিন্তার। শিক্ষকরা তথাকথিত সিলেবাসের বাইরে পাঠ দিতেন যুক্তি-বুদ্ধি বিকাশের। ছিল না কোনো শাস্তির ভয়। খোলা আকাশের নিচে বসে ক্রমে চিনতে আর বুঝতে শিখেছিলেন জীবনের স্কুলের প্রতিটি অধ্যায়কে।
কেমন ছিল সেখানকার পড়াশোনা? বাংলা আর সংস্কৃতের পাঠ দিতেন গোঁসাইজি, অর্থাৎ নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামী। বন্ধনহীন জীবনচেতনার পাঠ প্রথাগত পড়াশোনার গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে যেত ধর্ম-সংস্কারের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। প্রকৃতির স্নিগ্ধ পরশে শিক্ষা ও জীবনের বহুমুখী সমীকরণকে ভালোবাসতে শেখা তাঁর হাত ধরেই। সঙ্গে অবশ্যই থাকত রবীন্দ্রনাথের দর্শন। পরবর্তীকালে যখন ভিড়ের মধ্যে, ব্যস্ত স্টেশনে, এয়ারপোর্টের শব্দের মধ্যেও নিবিড় মনোযোগে লেখালেখি করতেন অমর্ত্য সেন, তখন অবাক হয়ে যেত বন্ধুরা। সেই অধ্যবসায়ের সূত্রপাত শান্তিনিকেতনেই, গোঁসাইজির ক্লাসেই।
পরীক্ষার নম্বর নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না সেখানে। পরীক্ষা বিষয়টিই ছিল আসলে গুরুত্বহীন। ভারতীয় দর্শন থেকে পাশ্চাত্যসাহিত্যের তত্ত্বের প্রসারিত বাতাবরণে সমৃদ্ধ ছিল সমগ্র পরিবেশ। চিন-জাপান থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মত বিনিময়ে এক উন্মুক্ত বৈচিত্র্য ছিল শান্তিনিকেতনে। নন্দলাল বসুর ‘পায়ের কাছে বসে’ অমর্ত্য সেন অনুভব করতেন প্রকৃতির ছন্দ আর জয়দেবের মেলার লোকশিল্পীদের সমারোহে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছেন বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে। বারবার ভেঙে বেরোতে চাইতেন প্রচলিত ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে। রীতিমতো অপছন্দ করতেন অঙ্কের সিলেবাসের বেশ কিছু অংশ। বরং বুঝতে চাইতেন বিশ্লেষণের মূল ভিত্তি আর গণিতের ধর্মকে। বলতেন, “একটা প্রজেক্টাইল কোথায় গিয়ে শেষ হবে সেটা আমি বের করে দিতেই পারি, কিন্তু এই অঙ্ক কষার কাজটাতে আমি একটুও আগ্রহ পাই না।” অঙ্কের শিক্ষক জগবন্ধুবাবু পর্যন্ত হার স্বীকার করে নেন ছাত্রের অধ্যবসায়ের কাছে। অফুরন্ত উৎসাহে দুজনে মিলে নতুন নতুন পদ্ধতিতে সমাধান করতেন অঙ্কের জটিলতা। পরে ট্রিনিটি কলেজে গণিতের ক্লাস করতে এসে দেখলেন, সেগুলির পাঠ অনেক আগেই শুরু হয়েছে জগবন্ধুবাবুর বাড়িতে। আবার তনয়েন্দ্রনাথ ঘোষের কাছে শুরু শেকস্পিয়ারের প্রথম পাঠ। আলোচনা চলত ‘ম্যাকবেথ’-এর আঁধারঘন পরিবেশ আর ‘কিং লিয়ার’-এর ভয়ঙ্কর বিষাদ নিয়ে। সাহিত্যের শিক্ষক ললিত মজুমদারের সঙ্গে খুলেছিলেন আদিবাসী ছাত্রদের জন্য রাতের স্কুল।
আরও পড়ুন
বিচ্ছেদের পরেও, জন্মদিনের লেখায় অমর্ত্যকে নবনীতা বলছেন - 'Treat this article as flowers...'
তবে সব বিষয়েই যে সমান পারদর্শী ছিলেন, তা নয়। বিশেষ করে হস্তশিল্পের কাজে নিজেকে দুর্বল বলেই দাবি করেন অমর্ত্য সেন। সহপাঠীরা যখন কাঠ কেটে নৌকো বানাত কিংবা পাটাতন বেঁকিয়ে নিয়ে বিভিন্ন আকার দিত, তখন সাবান কেস তৈরি পর্যন্ত ছিল তাঁর দৌড়। আর সমস্যায় পড়েছিলেন গান শিখতে গিয়ে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ছিল গানের ক্লাস। শান্তিনিকেতনে গানের পাঠক্রমের গুরুত্ব বেশি, প্রায় সবাইকে যোগ দিতে হত এই ক্লাসে। কিন্তু গান গাওয়াটা একেবারেই আসে না অমর্ত্যের। কিছুতেই সে কথা শুনবেন না ‘মোহরদি’। তিনি বিশ্বাস করতেন, সবার মধ্যেই গানের সহজাত প্রতিভা আছে। শুধু অভ্যাসের মাধ্যমে তাকে অন্তর থেকে জাগিয়ে তুলতে হয়। কিছুদিন ধৈর্য আর অধ্যাবসায় নিয়ে চেষ্টা করলেন অমর্ত্য সেন। নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো জায়গাই নেই। তবে আদৌ উন্নতি হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে প্রবল সন্দেহ আছে নিজের মধ্যে। মাসখানেক পরে পরীক্ষা নিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। কী হল পরীক্ষার ফল? কণ্ঠে কি তাহলে বাসা বাঁধল সুর? বিমর্ষ মুখে উত্তর এল, “অমর্ত্য, তোমায় আর গানের ক্লাসে আসতে হবে না।” মন খারাপ হলেও, পরে মনে হল একদিক থেকে যেন ভালোই হয়েছে। দর্শকাসন থেকে উপভোগ করতে পারবেন শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত শিল্পীদের সুরমাধুর্যকে।
আরও পড়ুন
বিশ্বভারতী এবং একটি পাঁচিল: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষারীতির ভিতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছে কি?
বহু পরে, ১৯৯৮ সালে বিবিসি-র একটি সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল অমর্ত্য সেনকে, “ঠিক কোন জায়গাটাকে আপনি আপনার বাড়ি মনে করেন?” তখন তিনি ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক। আপাতত সেখানেই বাসস্থান তাঁর। আবার আমেরিকার কেমব্রিজের পুরনো বাড়িটাও বড্ড কাছের। ভারতে এলে থাকেন শান্তিনিকেতনের বাড়িতে। যেখানে তিনি জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন। তাহলে কি নিজের বাড়ি বলে কিছু নেই তাঁর? উত্তর দিলেন অমর্ত্য সেন, “আমার একাধিক বাড়ি আছে, যেখানে আমি স্বচ্ছন্দে থাকতে পারি। তবে আপনি যে অর্থে একটাই বাড়ি বোঝাচ্ছেন, যার কোনও বিকল্প হয় না, আমার কাছে বাড়ির ধারণাটা একেবারেই সেরকম নয়।” সত্যিই তো, একটা বাড়ি কেন হতে হবে? সর্বত্র পূজনীয় বিদ্বানের মতো সমস্ত দেশেই ঘর তাঁর। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে তৈরি তার ইমারত। কেউ যদি ক্ষমতার দম্ভে একটা বাড়ি কেড়ে নিতে চায়, সম্মান কি ছিনিয়ে নিতে পারবে তারা? সেই মাটিতেই প্রকৃতির কোলে বসে শিক্ষা পেয়েছেন বিশ্বকে আত্মস্থ করার। আর তাই তো অমর্ত্য সেনের বাড়ির নাম ‘জগৎ কুটীর’। ভারতের হয়েও তিনি বিশ্বনাগরিক।
ঋণস্বীকার :
জগৎ কুটির, অমর্ত্য সেন, বাংলা সংস্করণ সম্পাদনা- অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, কুমার রাণা, সৌমিত্র শংকর সেনগুপ্ত
Powered by Froala Editor