শিক্ষককে গুরুদক্ষিণা দিতে বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিয়েছিলেন একলব্য। মহাভারতের এই গল্প তো আমাদের সকলেরই জানা কম বেশি। দ্বাপরের গল্পকথাকে কলিযুগে মিলিয়ে দিল জলপাইগুড়ির যুবক নিত্যানন্দ বর্মণ। মারণ ভাইরাসের ভয়কে অগ্রাহ্য করেই দিল গুরুদক্ষিণা। করোনা আক্রান্ত শিক্ষককে বাইকে বসিয়ে নিয়ে গেল হাসপাতালে।
এই মাসেরই ৪ তারিখ করোনা পজিটিভ এসেছিল জলপাইগুড়ির নেতাজী বিদ্যাভবনের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অনিত কুমার ঘোষের। সেইভাবে রোগের উপসর্গ না থাকায় বাড়িতেই সেলফ আইসোলেশনে ছিলেন তিনি। তবে ৪ তারিখ রাত থেকেই ধীরে ধীরে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। জ্বরও আসে তাঁর। অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজ করেও পাওয়া যায় না পরিষেবা। টোটো, অটো কিংবা অন্যান্য গাড়ির চালকরাও অস্বীকার করেন কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে।
পরদিন সকালেই স্যরের শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর পান নিত্যানন্দ। তৎক্ষণাৎ শিক্ষকের বাড়িতে পৌঁছান তিনি। দায়িত্ব তুলে নেন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর। কোনো পিপিই কিট নয়। হাতিয়ার কেবলমাত্র রেনকোট আর হেলমেট। বাড়িতে এন-৯৫ মাস্ক তো ছিলই। সেই পরেই বাইক নিয়ে কোভিড স্পেশাল ওয়ার্ডে শিক্ষককে নিয়ে যান নিত্যানন্দ।
“আমি মাধ্যমিক অবধি অন্য স্কুলে পড়েছি। উচ্চমাধ্যমিকে বাড়ির পাশে এই স্কুলে। তবে তার বহু আগে থেকেই পরিচয় স্যরের সঙ্গে। যেহেতু বাড়ির কাছেই থাকেন উনি। স্যরের পৈতৃক বাড়ি নদীয়ায়। কিন্তু কর্মসূত্রে উনি থাকেন জলপাগুড়িতে। অবিবাহিত। সেইভাবে কোনো আত্মীয়ও নেই স্যরের। ছাত্ররাই ওনার সব। তাই ছাত্র হিসাবেই এই দায়িত্বটা পালন করাটাই আমার কর্তব্য”, জানালেন নিত্যানন্দবাবু।
কোভিড আক্রান্তের সংস্পর্শে আসায় বেশ কয়েকদিন হোম কোয়ারেন্টাইনেও থাকতে হয়েছিল তাঁকে। তবে তাতে কী? প্রাণরক্ষা হয়েছে তো শিক্ষকের। গুরুদক্ষিণা দিতে পেরেই স্বস্তিতে রয়েছেন নিত্যানন্দবাবু।
তবে এই গল্পের পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে আরও এক গল্প। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী থেকেই একজন সক্রিয় সমাজকর্মী নিত্যানন্দ। দশম শ্রেণী অবধি রামকৃষ্ণ আশ্রমে পড়া নিত্যানন্দের জীবনের মূলমন্ত্রই হয়ে গেছে “জীবে প্রেম করে যেই জন/ সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর দায়িত্বই বহুদিন ধরে কাঁধে করে বয়ে চলেছেন নিত্যানন্দবাবু।
আরও পড়ুন
তরুণ প্রজন্মকে বইমুখো করতে নতুন লাইব্রেরি সুন্দরবনে
জলপাইগুড়ি শহরে কারোর রক্তের দরকার হলেই তাই এক কথায় সকলে স্মরণ করেন তাঁকে। না, কোনো ব্লাড ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত নয় তিনি। নিজের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে বটে। তবে নিত্যানন্দবাবু স্বয়ং নিজেই একটি চলমান ব্লাডব্যাঙ্ক। নিজে তো রক্তদান করেন বটেই। পাশাপাশি রক্তের চাহিদা মেটাতে গড়ে তুলেছেন একটি সমগ্র নেটওয়ার্ক। যার সঙ্গেই আলাপ হয় তাঁর, নিয়ে রাখেন রক্তের গ্রুপ। কারোর রক্তের দরকার পড়লেই এমনই দাতাদের মুহূর্তে ডেকে নেন তিনি।
“চার মাস অন্তর অন্তর রক্ত দেওয়া যায়। তাতে শরীরের কোনো ক্ষতিই হয় না। আমার পরিচিতদের মধ্যে কার কোন গ্রুপ, শেষ কবে সে রক্ত দিয়েছে, সবই আমার জানা। ফলে রক্তের চাহিদা মেটাতে কোনো অসুবিধাই হয় না। তবে অন্তঃসত্ত্বাদের রক্তদান একেবারেই উচিত নয়। তবে যারা রক্ত দিতে সক্ষম, তাদের বুঝিয়ে পথে আনাই আমার কাজ। আর আজ যে রক্ত দিচ্ছে, কাল তার প্রয়োজনেও আমি রক্তের ব্যবস্থা করে দিতে পারব। এ আমার স্থির বিশ্বাস”, বলছিলেন নিত্যানন্দ বর্মণ।
আরও পড়ুন
শাস্তির বদলে নিয়মিত আস্কারা পাচ্ছেন অপরাধীরা : উত্তরপ্রদেশের সমাজকর্মী বীণা রানা
কিন্তু জলপাইগুড়ির রোগীরা হামেশাই তো ভর্তি হতে আসেন কলকাতায়। সেখানে যদি তাঁদের প্রয়োজন হয় রক্তের? সেই সমস্যার সমাধান করতেও বার দুয়েক শহরে ছুটে এসেছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন সামান্য পরিচিতি। ধীরে ধীরে পরিধি বাড়বে তার। তখন আর সংকট থাকবে না রক্তের। এমনটাই আশা নিয়েই অক্লান্তভাবে লড়ে যাচ্ছেন নিত্যানন্দবাবু।
অন্যদিকে এই মহামারীর আবহে আর্থিকভাবে দুঃস্থ মানুষদের পাশে গিয়েও দাঁড়িয়েছেন তিনি। চলছে ত্রাণের কাজ। প্রতিদিন খাওয়ানোর বন্দোবস্ত। জলপাইগুড়ির রেডলাইট এরিয়াতেও পৌঁছে গেছে তাঁর সাহায্যের হাত। এলাকার নিঃসন্তান বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও ভরসা নিত্যানন্দ বর্মণের সংগঠন ‘গ্রিন জলপাইগুড়ি’।
আরও পড়ুন
থানা অব্দি পৌঁছয় না অনেক ধর্ষণের ঘটনাই, ক্ষোভে ফুঁসছেন উত্তরপ্রদেশের সমাজকর্মী রূপরেখা ভার্মা
“সরকার যেখানে পৌঁছাতে পারে না, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পৌঁছানোর কথা সেখানেই। সেই চেষ্টাটাই করে যাচ্ছি আমরা। আর মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছি যাতে তারাও এগিয়ে আসে এই উদ্যোগে”, এভাবেই নিজের কর্মযজ্ঞে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নিত্যানন্দবাবু। সামনে সমস্ত ঝড়-ঝাপটাকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উতরে দিতে প্রস্তুত তিনি। তাঁর এই একনিষ্ঠ চরিত্রই যেন বার বার মনে করিয়ে দেয়, সাদাকালো যুগের সেই গানটার কথা। ‘মানুষ মানুষের জন্য...’। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় একুশ শতকে এসেও একেবারে বদলে যায়নি পৃথিবী...
Powered by Froala Editor