হাতে ধরা সূক্ষ্ম লোহার পেনসিল। বাড়ির বারান্দার বসে তা দিয়েই শুকনো তালপাতার ওপর সযত্নে খোদাই করে চলেছেন কোনো শিল্পী। ওড়িশার নায়কপাটনা গ্রামে গেলেই চোখে পড়বে এই দৃশ্য। আজ থেকে প্রায় ৯০০ বছর আগে ওড়িশার (Odisha) বুকে জন্ম নিয়েছিল এই অভিনব পোথি শিল্প (Pothi Chitra)। তবে তালপাতার (Palm Leaves) ওপর খোদাইকার্য শ্রমসাধ্য হওয়ায় পরবর্তীতে ওড়িশার শিল্পীরা শিল্পের মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন কাপড়কে। পোথি শিল্প থেকেই বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় পটচিত্রের। আজ পটশিল্প জনপ্রিয় হলেও, সময়ের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে শিল্পের মূল ধারাটিই।
একটা সময় গোটা ওড়িশাতেই কাজ হলেও, আজ কেবলমাত্র প্রান্তিক গ্রাম নায়কপাটনাতে টিমটিম করে জ্বলে রয়েছে পোথিশিল্পের বাতি। আর তাঁর নেপথ্যে রয়েছেন ওড়িশার কিংবদন্তি পোথিচিত্র শিল্পী মগ নায়ক। প্রায় ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওড়িশার এই প্রাচীন শিল্পের ধারক ও বাহক তিনি। বংশানুক্রমিকভাবে শুধু শিল্পসৃষ্টিই নয়, তাঁর হাত ধরেই ধীরে ধীরে বাণিজ্যকরণের পথেও হাঁটছে এই শিল্প। পাশাপাশি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে তিনি পোঠি তৈরির কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে বিগত কয়েক দশক ধরেই। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের দৌলতে আজ উপার্জনের মূল মাধ্যম হিসাবে পোথিশিল্প বেছে নিয়েছেন গ্রামের ১১০টি পরিবার।
মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবার কাছে পোথিশিল্পের পাঠ নিয়েছিলেন মগ নায়ক। তবে কঠিন এই শিল্পকলা আয়ত্ত করতে খুব বেশি সময় লাগেনি তাঁর। কিশোর বয়স থেকেই পেশাগতভাবে পোথির কাজ করে আসছেন তিনি। তবে দেখতে দেখতেই চোখের নিমেষে বদলে গিয়েছিল গোটা গ্রামের পরিস্থিতি। পোথির চাহিদা কমে যাওয়ায় এই ব্যবসা ছেড়ে অন্য উপার্জনের দিকে ঝুঁকেছিলেন গ্রামের অধিকাংশ শিল্পীরাই। দু’দশক আগে পোথিশিল্পের সেই ব্যবসায়িক দিকটা নিশ্চিত করার পর বাড়িতেই প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু করেন মগ নায়ক। আর তাঁর সৌজন্যেই ফের চেহারা ফেরে নায়কপাটনার।
পোথিশিল্পের মূল প্রতিবন্ধকতা হল সময়। মগ নায়ক জানাচ্ছেন, প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা কাজ করার পরেও এক একটি তালপাতার পুঁথি নির্মাণেই সময় লেগে যায় কয়েক মাস। তালপাতা সংগ্রহের পর তার প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতিও বেশ দীর্ঘ। সেগুলিকে নিম ও হলুদের নির্যাস মিশ্রিত জলে ভিজিয়ে রাখা হয় দীর্ঘদিন। তারপর তা রোদে শুকানোর পর শুরু হয় সূক্ষ্ম খোদাই। মাথায় রাখতে হয়, কোনোভাবে যেন ছিঁড়ে না যায় মূল পাতাটি। সম্পূর্ণ খোদাই শেষ হলে, তার ওপর প্রলেপ পড়ে রঙের। সেই রঙও তৈরি হয় সম্পূর্ণ হাতে। বিভিন্ন পাথর থেকে। এক কথায় এই পরিশ্রম ধারণারও বাইরে। ফলত, এক একটি পোথির দাম পৌঁছায় প্রায় ২ লক্ষ টাকায়।
আরও পড়ুন
‘ধ্বংসেই শিল্পের সার্থকতা’, নিজের তৈরি মূর্তিতেই আগুন ধরিয়েছিলেন এই শিল্পী!
মূলত, বিভিন্ন পৌরাণিক গল্পের ছবি, কাহিনি এবং সংস্কৃত ও ওড়িয়া ভাষায় পূজার্চনার মন্ত্র লিপিবদ্ধ করা হয় পোথিতে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁদের মূল ক্রেতা নন। বরং, ওড়িশা-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মন্দিরগুলিতেই এই তালপাতার লেখা পুঁথি সরবরাহ করে চলেছেন মগ নায়ক। বর্তমানে জ্যোতিষ গণনা এবং কোষ্ঠী লেখার জন্যও অনেকে এই পোথির সন্ধানে আসছেন নায়কপাটনাতে। ভিড় জমাচ্ছেন বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রাহকরাও।
আরও পড়ুন
বয়স ২ লক্ষ বছর; পৃথিবীর প্রাচীনতম শিল্পকীর্তির সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা?
তবে নতুন করে লাভের মুখ দেখলেও অনিশ্চয়তা পিছু ছাড়েনি এখনও। কারণ, এই বিশেষ শিল্পের ক্ষেত্রে আগে থেকে অর্ডার নেওয়া হয় না কোনো। বরং, পোথি লিপিবদ্ধ হওয়ার পর, তা পছন্দ হলে তবেই সংগ্রহ করেন ক্রেতারা। কাজেই, বিক্রি না হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায় সমানভাবে। সেইসঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি স্ক্রিন প্রিন্টিং-এর সুযোগ এনে দিয়েছে তালপাতার ওপর। সেদিক থেকেও ক্রমশ প্রতিযোগিতা বাড়ছে বাজারে। আগামীতে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ কী, পরিণতিই বা কী— জানা নেই। তবে আধুনিকতার সঙ্গে এই অসম লড়াই-এ হার মানতে নারাজ ওড়িশার এই প্রান্তিক গ্রামের শিল্পীরা।
আরও পড়ুন
মহিলা শিল্পীদের কি প্রদর্শনীতে উলঙ্গ হয়ে ঢুকতে হবে? প্রশ্ন তুলেছিলেন গেরিলা গার্লরা
Powered by Froala Editor