সময়টা ১৯১৫ সাল। পাঞ্জাবের অমৃতসর শহর থেকে আমেরিকার উদ্দেশে পাড়ি দিলেন সাধারণ এক গৃহবধূ। ততদিনে বার্কলে শহরে একটি বাড়িও কিনে নিয়েছেন স্বামী বৈষ্ণোদাস বাগাই। কিন্তু যে দেশ ১৫০ বছরেরও বেশি সাদা চামড়ার মানুষের কাছে পরাধীন, সেখানকার কালো চামড়ার মানুষরা পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই যে সহজে সম্মান পাবেন না, তাতে আশ্চর্যের কী আছে? ঠিক সেরকম ঘটনাই ঘটল বৈষ্ণোদাস এবং তাঁর স্ত্রী কলা বাগাইয়ের সঙ্গে। নিজের বাড়িতে থাকতে পারলেন না বাগাই দম্পতি। বর্ণবিদ্বেষী প্রতিবেশীরা টেনে বের করে দিয়েছিলেন তাঁদের।
সেদিনের সেই অন্যায় ব্যবহারের প্রায়শ্চিত্ত করল বার্কলে শহর। আলোচনা চলছিল গত জানুয়ারি মাস থেকেই। অবশেষে মঙ্গলবার প্রথা মেনে স্যাটাক অ্যাভিনিউর নাম পরিবর্তন করা হল। বর্তমানে এই রাস্তার নাম কলা বাগাই ওয়ে। আর ভারতীয় তো বটেই, এই প্রথম আমেরিকার কোনো রাস্তার নামকরণ করা হল দক্ষিণ এশিয়ার কোনো ব্যক্তিত্বের নামে।
নিজেদের বাড়ি থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বাগাই দম্পতি। কিন্তু তাতে ফল হয়েছিল সম্পূর্ণ উলটো। ১৯২৩ সালে আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত তার কুখ্যাত রায়ে জানায় পরাধীন ভারতের কোনো মানুষ আমেরিকায় নাগরিকত্ব দাবি করতে পারেন না। স্বাভাবিক ভাবেই কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির উপর তাঁদের কোনো অধিকার থাকবে না। অতএব কলা বাগাই, বৈষ্ণো বাগাইয়ের মতোই অসংখ্য ভারতীয় আমেরিকায় থাকতে শুরু করলেন রিফিউজির মতো।
ততদিনে ভারতকে স্বাধীন করে তুলতে গদর দলের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ গড়ে তোলেন বৈষ্ণো বাগাই। আর এবার তার সঙ্গে শুরু হল অসংখ্য উদ্বাস্তুকে সংগঠিত করার কাজও। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশের মানুষও আমেরিকায় থাকতেন রিফিউজি হয়েই। সেইসমস্ত উদ্বাস্তুর কাছে কলা বাগাই পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘মাদার ইন্ডিয়া’ নামে।
আরও পড়ুন
রুপোলি পর্দার বাইরেও তিনি সুপারহিরো; বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্য নাম ‘বোসম্যান’
এর মধ্যেই ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পায়। ১৯৫০ সালে আরও এক ঐতিহাসিক রায় দেয় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট। আর সেই রায় অনুযায়ী নাগরিকত্বের অধিকার পান অসংখ্য উদ্বাস্তু। কলা বাগাই তখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তাঁর তিন সন্তান অবশ্য বড়ো হয়েছেন। তাঁরা নাগরিকত্ব পেলেন। আর ১৯৮৩ সালে আমেরিকার মাটিতেই মারা গেলেন কলা বাগাই।
আরও পড়ুন
বর্ণবিদ্বেষের শিকার প্রবাসী বাঙালি কিশোর, ‘আত্মহত্যা’র পিছনে লুকিয়ে কোন রহস্য?
নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে যে রাস্তার ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন কলা বাগাই, আজ সেই রাস্তার নাম তাঁর নামেই। জানুয়ারি মাসেই এই রাস্তার উন্নয়ন প্রকল্পের শুরুতে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা সারা আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে। আর এইসবকিছু মিলেই ১৫ জুলাই বার্কলে কাউন্সিলের সভায় বিনা বিরোধিতায় ঠিক হয় রাস্তার নামকরণ হবে কলা বাগাইয়ের নামেই। সেই ঘোষণা বাস্তবায়িত হল অবশেষে। ১৫ সেপ্টেম্বর এই পরিবর্তন বাস্তবায়িত হয়। নগর কাউন্সিল যে কলা বাগাইয়ের কথা মনে রেখেছে, তাতে খুশি তাঁর নাতনি রানি বাগাই। অন্যদিকে সমস্ত ভারতীয়ের কাছেই এ এক গর্বের বিষয়।
আরও পড়ুন
মাত্র ২২ বছর বয়সে ঘোষণা ‘আমিই আমেরিকা’, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার মহম্মদ আলি
Powered by Froala Editor