রবীন্দ্রনাথের 'স্ত্রীর পত্র' ও সনাতন আবহ

রাণী চন্দের সঙ্গে এ কথা সে কথা আলাপ করতে করতে একবার রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'স্ত্রীর পত্র' গল্পটি থেকেই তিনি বিশেষভাবে মেয়েদের নিজস্ব সমস্যার কথা বলতে আরম্ভ করেন। সিংহভাগ পাঠক এই গল্পটিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর বেদনা এবং নারীর প্রতিবাদের আখ্যান হিসাবে পড়তেই অভ্যস্ত। সহজ কিন্তু সুললিত ভাষা, নাটকীয় প্লট, এবং প্রোটাগোনিস্টের মুখে মেল-শভিনিজমের বিরুদ্ধে তীব্র সারকাজম— এই সবই এই গল্পের জনপ্রিয়তার রসদ জুগিয়েছে। বারেবারে এই গল্প চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, নায়িকার ভূমিকা নিয়েছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মতো নামজাদা অভিনেত্রী। ঋতুপর্ণ ঘোষ, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এ গল্পের বিভিন্ন ধাঁচের শ্রুতিরূপ নির্মাণ করেছেন। 

আসুন, গল্পটি ফিরে পড়ি। পুরুষতান্ত্রিক অনাচারের বিরুদ্ধে তীব্র ও স্পষ্ট বিদ্রোহ ঘোষণা তো এ গল্পে আছেই, আরও কিছু আছে কি? খুঁটিয়ে পড়লে দেখবেন, হ্যাঁ, আছে। এ আখ্যানে অন্তঃসলিলা হয়ে বয়ে চলেছে এক বিশেষ বেদনার স্রোত। 

নিজের রূপ সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন যুবতীদের প্রোটাগোনিস্ট করে রবীন্দ্রনাথ বারেবারে গল্প লিখেছেন। 'কঙ্কাল' গল্পের নায়িকা এরকমই এক চরিত্র, বাল্যবৈধব্যপীড়িত নিঃসঙ্গ জীবনে শশিশেখরের প্রণয়মুগ্ধ দৃষ্টি তাকে সাময়িক তৃপ্তি দিয়েছিল, কিন্তু সে সুখ তার কপালে সয়নি। শশিশেখরের বিবাহরাত্রেই ঈর্ষাপীড়িত নায়িকা তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যার ব্যবস্থা করে, ভূতপূর্ব শ্বশুরের ‘বিষকন্যা’ কটূক্তিকে ষোলো-আনা সার্থক করেছে। 'মানভঞ্জন' গল্পের গিরিবালাও স্বামীসোহাগ-বঞ্চিতা, পরিচারিকার রূপমুগ্ধ গদগদ বাচনে তো স্বামীর অভাব পূরণ হবার নয়। গিরিবালা তাই হয়ে গেল মঞ্চাভিনেত্রী। নাট্যের মায়াকাহিনিতে সে মানিনী নায়িকা হয়ে নায়কের অনুনয়-বিনয় উপভোগের সুযোগ পেল, অন্যদিকে বহু দর্শক-পুরুষের সৌন্দর্যাসক্ত দৃষ্টির অভিষেকও লাভ করল। গিরিবালার এই মায়া-সত্ত্বার মধ্যে রাধাকৃষ্ণ-কাহিনির অনুপ্রেরণা রয়েছে একেবারে প্রত্যক্ষভাবে, সক্রিয়ভাবে। 'স্ত্রীর পত্র' গল্পের মৃণাল এই ধারাতেই পড়ছে। তার সমাধান-চেষ্টাটি বোধ করি সবচেয়ে সূক্ষ্ম। পুরুষের প্রেমমুগ্ধ দৃষ্টির অভাব মেটাতে সে বাস্তব জীবনের কোনো জলজ্যান্ত পুরুষ, কিংবা মঞ্চমায়ার নায়ককে নয়, বেছে নিয়েছে খোদ ভগবানকে। 

গল্পে দেখছি, বারো বছর বয়সে মৃণালের বিবাহ। বিবাহের পনেরো বছর বাদে তার শ্রীক্ষেত্র যাত্রা। সেই শ্রীক্ষেত্রে, পনেরো বছর বাদে মৃণালের উপলব্ধিতে ধরা দিয়েছে ‘জগত ও জগদীশ্বরের সঙ্গে তার অন্য সম্বন্ধ’, যে সম্বন্ধ এতদিন তার জানা ছিল না৷ কী সেই সম্বন্ধ, যা বিবাহের আগে তার অজ্ঞাত ছিল, এখন জ্ঞাত? সে কথার সন্ধানে, মৃণালের বিবাহের ইতিহাসটি একবার পর্যালোচনা করা যাক।

মৃণালের বাপের বাড়ি অতি দুর্গম পাড়াগাঁয়ে। আর্থিক স্বচ্ছলতা বা বিরাট কুলমর্যাদার কোনো ইঙ্গিত তার জবানিতে অন্তত নেই। তা সত্ত্বেও, মৃণালকে কেন বধূ হিসাবে নির্বাচিত করা হল? কারণ, বড়োবৌমার রূপের অভাব মেজোবৌমাকে দিয়ে পূরণ করবার জন্য মৃণালের শাশুড়ির একান্ত জেদ। অর্থাৎ সেই বারো বছর বয়সে, বয়ঃসন্ধির শুরুর দিকেই মৃণাল পরিপার্শ্ব থেকে বুঝতে পারল, ইহসংসারে তার প্রধানতম পুঁজিটি হচ্ছে তার রূপ। 

এইখানেও একটা মুশকিল। এই মুশকিলের কথাটি, সেই বয়সেই মৃণালের অগোচর থাকেনি৷ সেটি কী? বধূ হিসাবে যোগ্যতার পাসমার্ক পাওয়ার জন্য "মেয়ের রূপের উপর ভরসা; কিন্তু, সেই রূপের গুমর তো মেয়ের মধ্যে নেই, যে ব্যক্তি দেখতে এসেছে সে তাকে যে-দামই দেবে সেই তার দাম। তাই তো হাজার রূপে গুণেও মেয়েমানুষের সংকোচ কিছুতে ঘোচে না।" অর্থাৎ রূপ জিনিসটা এমনই, তার দাম দর্শক-সাপেক্ষ। দর্শক যদি তাকে সুন্দর বলে দাম দেয়, তবেই তার দাম। এই মুশকিলটিই আসলে, মৃণালের যাবতীয় সমস্যার প্রধান উৎস।

যাই হোক, মৃণালের দূর সম্পর্কের মামাশ্বশুর এবং পতিবন্ধু নীরদ— এই দুই পরীক্ষক-দর্শকের চোখে তার রূপ পাস-মার্ক পেল, সে কলকাতার বাড়িতে বধূ হয়ে এলো (রূপ জিনিসটি নিয়ে এমন পাস-ফেলের পরীক্ষা, তার শরীরের উপরে দুই অচেনা পুরুষের judgemental দৃষ্টিপাত,  সদ্যকিশোরী মৃণালকে স্বস্তি দেয়নি। কিন্তু তার "কোথাও লুকোবার জায়গা ছিল না।") বাড়ির গিন্নির দল তার খুঁতগুলি (এই খুঁত নিশ্চয়ই শারীরিক খুঁত) সবিস্তারে খুঁটিয়ে দেখেও রায় দিলেন, মোটের উপর সে ‘সুন্দরী বটে’। 

কিন্তু, মৃণালের রূপের গৌরব তো শ্বশুরবাড়িতে বেশিদিন টেকেনি। মৃণাল বলছে, "আমার রূপের দরকার কী ছিল তাই ভাবি।" দর্শকের মুগ্ধ প্রশংসা না পেলে রূপের মূল্য নেই, এ কথা পরিপার্শ্বের চাপে তার হাড়েমজ্জায় গেঁথে গেছে। কেন পতিগৃহে রূপের কদর নেই? মৃণাল শ্লেষের সঙ্গে বলছে, রূপ জিনিসটা কোনও সেকেলে পণ্ডিত গঙ্গামৃত্তিকা দিয়ে গড়লে ব্যাপারখানা অন্যরকম হতে পারত, কিন্তু রূপ তো বিধাতার আপন আনন্দের সৃষ্টি, তাই "তোমাদের ধর্মের সংসারে ওর দাম নেই।" এবং, "আমার যে রূপ আছে, সে কথা ভুলতে তোমাদের বেশিদিন লাগে নি।" অভিজ্ঞ পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে নেবেন, মৃণাল গৌরবে বহুবচন ব্যবহার করছে বটে, কিন্তু তার অভিযোগের প্রকৃত লক্ষ্য একটি মানুষ, তার স্বামী। কেন? প্রথমত, এই ব্যক্তিগত চিঠিটি একান্তভাবে তার স্বামীর উদ্দেশেই লেখা, আর দ্বিতীয়ত, নারীর রূপের কদর তার সমাজ-স্বীকৃত পুরুষসঙ্গীটির কাছ থেকেই তো সর্বাধিক প্রত্যাশিত। 

যাই হোক, এইসব অতৃপ্তি সত্ত্বেও মৃণালের দিন একরকম করে কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু বিন্দু নামক সদ্যকিশোরীর আবির্ভাবেই বড়ো গোল বাধল। মৃণাল বলছে, "(বিন্দু) আমাকে এমনি ভালোবাসতে শুরু করলে যে, আমাকে ভয় ধরিয়ে দিলে। ভালোবাসার এরকম মূর্তি সংসারে তো কোনোদিন দেখি নি। বইয়েতে পড়েছি বটে, সেও মেয়ে পুরুষের মধ্যে। আমার যে রূপ ছিল সে কথা আমার মনে করবার কোনো কারণ বহুকাল ঘটে নি— এতদিন পরে সেই রূপটা নিয়ে পড়ল এই কুশ্রী মেয়েটি।" মৃণাল নিজের সহজাত বুদ্ধি এবং বই-পড়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে বেশ বুঝছে এটা শৃঙ্গার-রস-বিরহিত কোনও সামান্য ঘটনা নয়, এই জিনিস সাধারণত নারী-পুরুষের মধ্যেই ঘটে থাকে। এবং এইটিই তার মনে ভয় জাগাচ্ছে। পাঠক, লক্ষ্য করুন, এ হেন রূপমুগ্ধতা কিন্তু এযাবৎ মৃণালের অভিজ্ঞতায় নেই, অর্থাৎ এতদিন স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্যযাপন করেও সে এহেন রূপমুগ্ধ ভালোবাসার অভিজ্ঞতা লাভ করেনি। অথচ স্বামীর সঙ্গে যৌনতার অভিজ্ঞতা সে তো নিশ্চিতভাবে লাভ করেছে, কারণ সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। তাই মৃণালের অতৃপ্তিটা নেহাত যৌন অতৃপ্তি, এমন মোটা দাগের সিদ্ধান্ত কোনওভাবেই করা যাবে না। সহজাত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিণী, সুশিক্ষিত ও নানারকম বই পড়তে অভ্যস্ত মৃণাল, যে কিনা লুকিয়ে কবিতা লেখে, তার সূক্ষ্ণ সংবেদনশীল মন তো কেবল যৌনতায় তৃপ্তি পাবে না! তার তো রোম্যান্টিক প্রেমযাপনের আকাঙ্ক্ষা থাকবেই। আর এই আকাঙ্ক্ষার অপূর্তির জন্যই তার সমস্যা৷ 

মৃণাল বলছে, "বিন্দুর ভালোবাসার দুঃসহ বেগে আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। এক একবার তার উপর রাগ হত, সেকথা স্বীকার করি, কিন্তু তার এই ভালোবাসার ভিতর দিয়ে আমি আপনার একটি স্বরূপ দেখলুম যা আমি জীবনে আর কোনোদিন দেখি নি। সেই আমার মুক্ত স্বরূপ।" স্বাভাবিক। পুরুষের প্রেমপ্রত্যাশী মৃণাল নারীর মুগ্ধতায় পূর্ণত তৃপ্তি পায়নি, ঠিক যেমন পায়নি গিরিবালা। কিন্তু, এই অনুকল্প প্রাপ্তিটুকুর মাধ্যমেই, মৃণাল বুঝতে পেরেছিল, তার আসলে ঠিক কী চাই।

সে কারণেই, বিন্দুর আত্মহত্যার পরেও সে শ্রীক্ষেত্রে এলো। মৃণাল বলছে, "বিন্দুর আর আসবার দরকার হল না, কিন্তু আমার দরকার ছিল।" 

কী সেই দরকার? নিজের সম্মুখে রূপমুগ্ধ পুরুষ হিসাবে স্বয়ং ভগবানকে স্থাপন করা যায়, এমন একটা পরিবেশ। শ্রীক্ষেত্রে মৃণাল পাচ্ছে - মাথার ওপরে আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ, আর সম্মুখে নীল সমুদ্র— এই দুই বিরাটের সান্নিধ্য, যা অসীম তথা অনন্তকে উপলব্ধির সহায়ক। তৃপ্তি পাচ্ছে তার রোম্যান্টিক কবি-মানস। সেইসঙ্গে এও মনে রাখতে হবে, এই শ্যামাভ প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলিই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণবসাধকদের অন্তরে জাগাত শ্যামসুন্দর ভগবানের বিভ্রম, জাগাত প্রেমোন্মত্ততা। কে এই শ্যামসুন্দর ভগবান? ‘জীবনের যমুনাপারে’ ‘মৃত্যুর বাঁশী’ বাজার অনুষঙ্গ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইনি বৃন্দাবনবিহারী বংশীবাদক কৃষ্ণ। মেজোবৌয়ের খোলস ছিন্ন করে, শ্বশুরকুলের চরণতলাশ্রয় থেকে চিরকালের মতো সরে এসে, শ্রীক্ষেত্রাধিপতি জগন্নাথ-কৃষ্ণই এখন মৃণালের ভাবজগতের অবলম্বন, মৃণালের ‘অনাদৃত রূপ’-এর মুগ্ধ দর্শক। 

সেকালে বঙ্গদেশের হিন্দুসমাজে বিধবার বিকল্প পতি হিসাবে কিশোরকৃষ্ণ ভজনা, কিংবা সন্তানহীনার বালগোপাল আরাধনা বহুল প্রচলিত ছিল৷ এই সামাজিক প্রবণতাটির এই গল্পে প্রভাব বিস্তার করা খুবই সম্ভব। সেইসঙ্গে, গৃহস্থ জীবনের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করে শ্রীক্ষেত্রধামে গমন, এবং পরমপ্রিয় স্বরূপে পরমেশ্বরের আরাধনা, কাহিনির এই অংশটুকু পড়ে সচেতন বাঙালির মনে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের জীবনবৃত্তান্ত স্মরণে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু, মৃণাল চরিত্রটি সর্বাংশে এই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সাধনপরম্পরার উত্তরসূরি নয়। তার একটা স্বাতন্ত্র্যা আছে। 

কী সেই স্বাতন্ত্র্য? মৃণাল বলছে, "আমার এই অনাদৃত রূপ যাঁর চোখে ভালো লেগেছে, সেই সুন্দর সমস্ত আকাশ দিয়ে আমাকে চেয়ে দেখছেন।" পরমপ্রিয় ঈশ্বরের কাছে মৃণালের পূজার অর্ঘ্য কী? তার সাতাশ বছরের যৌবনঋদ্ধ নারীশরীরের 'রূপ'। যে রূপের কদর সে শ্বশুরবাড়িতে এবং স্বামীর কাছে যথেষ্ট পাচ্ছিল না, যে রূপের প্রতি মুগ্ধ স্তুতিবাচন করার একটিমাত্র মানুষ অর্থাৎ বিন্দু আর ইহলোকে নেই, সেই "অনাদৃত রূপ"-এর এক প্রণয়মুগ্ধ দর্শক রূপে সে তার ভাবলোকের পরমেশ্বরকে চিন্তা করেছে। নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব ঐতিহ্যের কোনও সাধন-অভিজ্ঞ ব্যক্তিই কি মৃণালের এই চিন্তাকে সমর্থন করবেন? যৌবনের উপস্থিতিতে সাময়িক সৌন্দর্যের আধার যে মর্ত্যদেহ, যা ব্যাধি-জরা-মৃত্যুর কবলে পড়ে নিশ্চিতভাবেই একসময় রূপের ঐশ্বর্য হারাতে বাধ্য, তা কি কখনওই কালাতীত পরমেশ্বরের সঙ্গে প্রণয়সম্পর্কের নির্ভরস্থল হতে পারে? 

মৃণাল নিজের চিন্তা, বাক্য ও আচরণের সমর্থনে এরপর একজন ইতিহাস-খ্যাত পূর্বসূরির উল্লেখ করেছে। মৃণাল বলছে, "মীরাবাঈ তার গানে বলেছিল,'ছাড়ুক বাপ, ছাড়ুক মা, ছাড়ুক যে যেখানে আছে, মীরা কিন্তু লেগেই রইল, প্রভু- তাতে তার যা হবার তা হোক।'" এটি সম্ভবত মীরাবাইয়ের "মেরে তো গিরিধর গোপাল দুসরা না কোই" ইত্যাদি গানের একটি আংশিক ভাবানুবাদ। এই গানের দুটি চরণ উদ্ধার করা যাক, "তাত মাত ভ্রাত বন্ধু আপনো না কোই/ ছাঁড়ি দী কুল কি কানি কহা করিহৈ কোই।।" পরিবারব্যবস্থা সম্পর্কে বৈরাগ্যবশত কুলত্যাগ, এবং একমাত্র গিরিধারী গোপালরূপী পরমেশ্বরের আশ্রয়গ্রহণ, এই অবধি মীরাবাইয়ের ভাবের সঙ্গে মৃণালের আচরণ বেশ মিলে যাচ্ছে মনে হয়। কিন্তু, সবটাই কি মেলে? 

মীরার কিংবদন্তি-নির্ভর জীবনগাথা থেকে জানা যায়, তিনি আশৈশব কৃষ্ণকেই নিজের পতি বলে জানতেন, তাঁর চিন্তালোকে কৃষ্ণের সঙ্গে দাম্পত্য এক নিতান্ত সহজ স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। অন্যদিকে, মৃণালের এই ঈশ্বরপ্রেম একটা আকস্মিক ব্যাপার, বহু বছরের অতৃপ্তির ক্ষতিপূরণের জন্য একটা হঠাৎ-আঁকড়ে-ধরা ব্যাপার। এবং, মীরা কিন্তু এই প্রেমব্যাপারে মর্ত্যদেহ-সর্বস্ব চিন্তা পোষণ করতেন না। শ্রীরূপগোস্বামীর বাহ্যদেহনির্ভর পুরুষত্বকে অস্বীকার করার কাহিনীতেই তার প্রমাণ। অন্যদিকে, মৃণালের এই ঈশ্বরপ্রেমের ভিত্তিই হচ্ছে তার নশ্বর মর্ত্যদেহ। তাহলে, মৃণালকে তো মোটেও মীরার ধর্মভাবনার যথাযথ উত্তরসূরী বলা চলে না! 

মৃণালের সতীসাধ্বী বড়ো জা যে-কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্য পতিদেবতার বদলে বিশ্বদেবতাকেই দোষ দিতে চেষ্টা করতেন, তাঁর এই আত্মপ্রবঞ্চনা নিয়ে মৃণাল তার চিঠির মধ্যে অল্পস্বল্প কৌতুক করেছে৷ কিন্তু, মৃণালের এই পতিদেবতার বিকল্প হিসাবে বিশ্বদেবতাকে বেছে নেওয়ার মধ্যেও কি তার অজান্তেই একটা বিরাট বড়ো আত্মপ্রবঞ্চনা লুকিয়ে নেই? এই আকস্মিক, পরম্পরা-অসিদ্ধ, একান্ত দেহসর্বস্ব ঈশ্বরপ্রেমের মধ্যে কি সে আদৌ স্থায়ী শান্তির সন্ধান পাবে? 

ছোটোগল্প খণ্ডোপজীবী, তাই মৃণালের ভবিষ্যত কিংবা তার পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনার দায় রবীন্দ্রনাথের নেই৷ কিন্তু, উত্তেজক কথাবার্তার রোশনাই থেকে একটু যদি সরে আসা যায়, তাহলে সচেতন পাঠক হয়তো বা এই গল্পের শেষে মৃণালের জন্য একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। রবীন্দ্রনাথের শব্দগুচ্ছ ধার করেই মৃণালের সম্বন্ধে বলবেন, "হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।"

Powered by Froala Editor