রবিনসন ক্রুসোর গল্পের সঙ্গে সকলেই পরিচিত আমরা। জাহাজ দুর্ঘটনাই তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল জনমানবহীন এক দ্বীপে। সেই নির্জন দ্বীপেই বছরের পর বছর কাটিয়েছিলেন তিনি। তারপর মুক্তি। তেমন ঘটনা ঘটল বাস্তবেও। সম্প্রতি, মুক্তি পেলেন বাস্তবের রবিনসন ক্রুশো মহম্মদ আইশা। ‘অভিশপ্ত’ পরিত্যক্ত জাহাজে নিঃসঙ্গ চার বছর কাটানোর পর এবার বাড়ি ফিরলেন তিনি।
তবে রবিনসন ক্রুশোর মতো জাহাজডুবির সাক্ষী হয়ে হয়নি মহম্মদকে। বরং তাঁর এই নিঃসঙ্গযাপন যেন ভাগ্যেরই পরিহাস। ২০১৭ সালের কথা। মিশরের বন্দর আদাবিয়াতে নোঙর ফেলে সিরিয়া থেকে আগত জাহাজ এমভি আমন। তবে মালবাহী আমনের সার্টিফিকেটের মেয়াদ যে ফুরিয়ে গিয়েছিল আগেই, তা খেয়াল করেনি জাহাজ কর্তৃপক্ষ। ফলত বন্দরেই আটক করা হয় জাহাজটিকে।
কেবলমাত্র জরিমানা দিয়েই জাহাজটি মুক্ত করতে পারত জাহাজ কর্তৃপক্ষ। তবে আগে থেকেই এই জাহাজের জন্য দেনায় ডুবে ছিলেন মালিক। লেবাননের পথে আসার সময় জ্বালানির জন্য নেওয়া হয়েছিল বড়ো অঙ্কের ঋণ। জরিমানা দেওয়ার আগে পরিশোধ করতে হত সেই আর্থিক বোঝা। আর সেই কারণেই, মিশর প্রশাসনের থেকে জাহাজ ছাড়াতে কোনোরকম উদ্যোগই নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু কতদিন আর এভাবে আটকে থাকা যায় উপার্জনহীনভাবে? তাই একে একে নতুন কাজের সন্ধানে দেশে ফিরেছিলেন এমভি আমনের সকল নাবিক ও কর্মীরাই। শুধু ফেরা হয়নি মহম্মদের। জাহাজের চিফ অফিসার হওয়ার জন্য ‘শাস্তি’-র নিদান দেওয়া হয় তাঁকেই। মিশর আদালত জাহাজটির তত্ত্বাবধানের জন্য অভিভাবকত্বের গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিল তাঁর ওপরেই। ফলত, জাহাজে একা না থেকে উপায়ই বা কী? এমন অবস্থায় মিশর ছাড়লেও যে নিস্তার পাওয়া যাবে না আন্তর্জাতিক আইন থেকে। তাই দীর্ঘ চার বছর এই পরিত্যক্ত জাহাজেই কাটিয়েছেন তিনি।
কয়েক মাস পরই ফুরিয়ে গিয়েছিল জ্বালানি। কাজেই ছিল না বিদ্যুৎ। কথা বলার সঙ্গীও। শুধু হতাশা আর বিষণ্ণতার এক সমুদ্রের মধ্যে একা বসে মুক্তির প্রহর গুনতেন মহম্মদ। ২০১৮ সালে এমন ‘বন্দি’ অবস্থাতেই মায়ের মৃত্যুর খবর পান তিনি। তবে শেষ দেখাটুকু করার সুযোগ মেলেনি আদালতে আবেদন করেও। ২০২০ সালে ভয়ঙ্কর একটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে পড়েন মহম্মদ। আর সেই দুর্যোগই যেন ভাগ্য ফিরিয়ে দেয় তাঁর। নোঙর ছিঁড়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে চলে যায় জাহাজটি। আটকে যায় অগভীর জলে। সেই প্রথম প্রায় তিন বছর পরে জাহাজ থেকে নেমে বাইরের পৃথিবীর সংস্পর্শে আসা। প্রশাসনের কাছে আবেদন করাও সে-সময়েই। আর শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই আবেদন মঞ্জুর করেছে মিশর। বিমানে সিরিয়ার ফেরানোর বন্দোবস্তও করে দিয়েছে তারা।
তবে এই গল্প শুধু একা মহম্মদের নয়। পরিসংখ্যান বলছে, সারা পৃথিবীজুড়ে ঠিক আমনের মতোই আটকে রয়েছে ২৫০টি জাহাজ। জাহাজ ছাড়ানো লাভজনক না হওয়ায়, নাবিকদের সম্পূর্ণভাবে প্রতারিত করেছে মালিক কর্তৃপক্ষ। তাঁদের অঘোষিত এক নির্বাসনে পাঠিয়ে সমস্ত যোগাযোগই বন্ধ করে দিয়েছে তারা। সম্প্রতি ইরানের একটি বন্দরে সামনে আসে এমনই একটি ঘটনা। আটকে থাকা ভারতীয় জাহাজ ‘উলা’-র ১৯ জন নাবিক অনশনে বসেন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে। তবে লাভ হয়নি কোনো।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা আইএলও-র মতে সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি বেড়েছে এই ঘটনার প্রবণতা। শুধু ২০২০ সালেই ঘটেছে এমন ৮৫টি ঘটনা। যা নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানের উপায় কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে রয়েছে বড়োসড়ো ফাঁক। মালিকদের এই অবহেলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে যে সেই আইনের সংশোধন দরকার, তা স্পষ্টভাবেই জানাচ্ছে আইএলও। তবে এই আর্জি কবে বাস্তবায়িত হবে তা জানা নেই কারোরই…
Powered by Froala Editor