দেশের মোড়ল-কে দেখতে আসা, ‘সাধারণ’ লেনিনকে চিনতে পারল না চাষিরা

"Politics begin where the masses are, not where there are thousands, but where there are millions, that is where serious politics begin."

১৯১৭ সালে দখল হয়েছিল শীতপ্রাসাদ। সাম্রাজ্যবাদী 'জার'কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে রাশিয়ার মানুষ। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছিল যৌথখামার। কারখানার মালিকানা সঁপে দেওয়া হয়েছিল শ্রমিকদের হাতেই। সেই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যিনি, তাঁর আজ জন্মদিন। ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানোভ, ওরফে লেনিন, আজ পড়লেন একশো একান্ন বছরে।
লেনিনকে নিয়ে একগাদা গপ্প ছড়িয়ে আছে সোভিয়েত রুশিয়ায়। তার একটা রইল আজ….

কোস্ত্রোমা জেলার চাষিরা এসেছে লেনিনের খোঁজে। কমরেড লেনিন নাকি রয়েছেন পেত্রোগ্রাদে। 'দেশের কত্তা লেলিনসাহেব'। ঘোড়ার মুখের খবর। তাই পত্রপাঠ, দপ্তরের প্রথম ঘণ্টাতেই তারা হাজির।

লেনিনকে কেউ কস্মিনকালে দেখেনি। প্রত্যেকের মনে প্রশ্ন। কেমন চেহারা? বয়স কত? ছোকরা? বুড়ো?

"খুব লম্বাচওড়া বুইলে! ছাতিখানা ঠিক যেন ইস্টিমারের ইঞ্জিন…"

"নাগো না! বেঁটেখাটো। কিন্ত বেশ মোটাসোটা। অনেকটা আমাদের গেরামের ডাক্তারবাবুর মতো…"

ইতিউতি চাইতে গিয়ে দেখতে পেল, একজন মাঝবয়সী দাড়িওয়ালা লোক হনহনিয়ে হেঁটে আসছে। চাষিরা ওকে থামায়।

"ওওওও ভাই!"

"বলো!"

"শুনলুম, মোড়লমশাই এখেনে এয়েচেন?"

"মোড়লমশাই?"

"দেশের মোড়ল গো! যিনি রাশিয়ার কত্তা। আমাদের দেখভাল করেন…"

আগন্তুকের দুচোখে ঈষৎ দুস্টুমির ঝিলিক খেলে গেল। তারপর আঙুল দিয়ে সে ভিড়ের উদ্দেশ্যে দেখায়…

"মোড়লমশাই হুইই দাঁড়িয়ে… ওইখেনে।"

হনহনিয়ে আবার হাঁটা দিল সে।

চাষিরা সারা ঘরে নজর চালাল। এককোণে একদল শ্রমিক বসে। তাদের ঠিক পেছনে সৈন্যরা মেতে উঠেছে তর্কে। একটু দূরেই দেওয়ালে ঠেসান দেওয়া, 'অরোরা' জাহাজের একজন খালাসি। নিশ্চিন্তে সিগারেট টানছে। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, চাষিরা। তাদের পরনে পশমের কোট, কানে মাফলার। তারাও বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে।

কিন্ত ভিড়ের মাঝে 'মোড়লমশাই' কই? কাউকেই তো ঠিক…

নিজেদের মধ্যে ফিসফাস চলে…

"ওই 'দেড়েল' লোকটা নির্ঘাৎ ভুল করেছে… গন্যিমান্যি মানুষ… আমাদের মতো হাড়হাভাতেদের কি দেখা দেবেন? হাজার হোক দেশের কত্তা বলে কতা!"

হঠাৎ একটা অচেনা কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে চাষির দল।

"ও খুড়োরা… ইদিকে পেরথমবার আসা হয় নাকি?"

শ্রমিকদের জটলা থেকে বেরিয়ে এক ছোকরা, দাঁড়িয়েছে ওদের পাশেই।

"হ্যাঁ গো, বাবাসোনা। লেনিনসাহেবকে খুঁজতে এয়েচি। দেখিয়ে দেবে?"

"লেনিনসাহেব?"

"হ্যাঁ!"

"কিন্ত তোমরা তো ওর সঙ্গেই এতক্ষণ কথা কইছিলে!"

"মানে? ওই দাড়িওয়ালাটা?"

"হ্যাঁ গো!"

"সব্বোনাশ!"

বিস্ময়ে থম মেরে যায় চাষির দল। মুখে কথাটি সরে না। এ কী করে ফেলল তারা! কার সঙ্গে, কীভাবে কথা বলে ফেলেছে! এবার উপায়? অনেক কষ্টে, ভেঙে ভেঙে গোটা ঘটনাটা তারা বলে, ছোকরাকে।

শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল যুবক। তারপর হাসি থামিয়ে বলল,

"কমরেড লেনিনের সঙ্গে দেখা কত্তে চাইলে, সিঁড়ি বেয়ে তেতলায় উঠে যেতে পারো। আর যদি তোমাদের 'মোড়লমশাই'কে খুঁজতে চাও… তাহলে কমরেড তোমাদের ঠিকই দেখিয়েছেন।"

শ্রমিকটি মিশে গেল ভিড়ে।

চাষিরা ধন্ধে পড়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ থ' হয়ে বসে থাকে।

"কিছু বুঝলুম নাগো!"

"বড়ো মানুষদের হেঁয়ালি করাই স্বভাব !"

কূটকাচালি চলতে থাকে। কিন্ত দলের সবথেকে বয়স্ক চাষিটি ডুবে গিয়েছে ভাবনায়। বলিরেখা ভাঁজ হয়ে মুখখানা যেন দোমড়ানো খবরের কাগজ। ভাবতে ভাবতে, কুঁজো হয়ে বসে পড়েছে। তাকে ঘিরে দলের অন্য সদস্যরা। হঠাৎ হেসে ফেলল সে। যেন উত্তর মিলেছে! ঝিকমিকিয়ে উঠল চোখ। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় বাকিরা।

"কিছু ঠাহর কত্তে পারলে খুড়ো?"

একগাল হেসে বুড়ো বলে…

"হ্যাঁ ! ঠিকই তো বলেছে লেনিনবাবা! ভাইসকল, চল আমার সঙ্গে।"

তিনতলার এককোনায় লেনিনের ঘর। ঘরের সামনে বসে কলম পিষছে একজন কেরানি।

"কাকে চাই?"

"লেনিনের সঙ্গে দেখা করব।"

"আচ্ছা, পাঠাচ্ছি। কী নাম বলতে হবে?"

বৃদ্ধ চাষি, সাদা গোফজোড়া খানিক চুমরে নিল। তারপর একটু ঝুঁকে, চাপা গম্ভীর গলায় বলল,

"গিয়ে বলো, দেশের মোড়লমশাই, রাশিয়ার কত্তা দেখা করতে এয়েচেন।"

সূত্র : Russian History In Tales, Progress Publishers 1975

Powered by Froala Editor