কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হল। সন্ধে নেমে এসেছে শহরে। আলোগুলো একটু একটু করে ফুটে উঠছে। হলে লোক ভর্তি। সেমিনার? না, নাটক হবে। বিখ্যাত একটি নাটক। স্বয়ং রচয়িতাও অবতীর্ণ হবেন মঞ্চে। সেই ভিড়ে ঢুকে পড়ে একটি কিশোরও। নাটকে তাঁর ভীষণ নেশা। মঞ্চে তখন শুরু হয়ে গেছে খেলা। দেখা যাচ্ছে একটা লোককে। ম্যানহোল থেকে ময়লা তুলছে, আর বালতি বোঝাই করছে। হঠাৎই একটু ময়লা এসে পড়ে পাশের বাবুটির গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে তিরস্কার, “অ্যাই, তুই কে?” ওই লোকটির জবাব আসে, “বাবু, আমি এই শহরের নীচে থাকা মানুষ।” গায়ে যেন কাঁটা দিল ছেলেটার। সত্যিই তো, এই মানুষগুলোর কথা তো ভাবি না আমরা। অথচ প্রতিটাদিন শহরটা টিকে থাকে এদের জন্য। শুধু চরিত্রগুলো বাঁচছে না; বাঁচছে প্রতিটা মানুষ। সেখানে সামিল অভিনেতারাও। সেদিনের ওই কিশোর, দেবশঙ্কর হালদার, পরে আঁকড়ে ধরবে নাটককেই। আর যে নাটকটি চলছিল? নাম, ‘টিনের তরোয়াল’। বেণীমাধবের ভূমিকায় আর কেউ নন, স্বয়ং উৎপল দত্ত!
আরও পড়ুন
তখনও ছাত্রাবস্থা পেরোননি জসীম উদ্দীন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা পড়ানো শুরু হল তাঁর
একটি স্মৃতিচারণায় এমনটাই বলেছিলেন দেবশঙ্কর। নাটকে ঝাঁপিয়ে পড়া ওই মানুষটিকে দেখে। শুধু তিনি কেন, তাঁর মতো আরও বহু শিল্পী, অভিনেতার প্রেরণা ছিলেন উৎপল দত্ত। বাঙালির কাছে তিনি কখনও মগনলাল মেঘরাজ, কখনও হীরক রাজা; কখনও আবার ‘আগন্তুক’ মনমোহন মিত্র। আরও কত চরিত্রে তাঁকে পেয়েছি আমরা! সেই সঙ্গে নাট্যকার, নাট্যকর্মী উৎপল দত্তের কথা কি ভোলা যায়? অন্তত বাংলা, ভারতীয় নাট্যজগত যতদিন আছে, উৎপল দত্ত ও তাঁর সৃষ্টি থেকে যাবে।
আরও পড়ুন
অভিনয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ, দর্শকাসনে নেতাজিও – থামল কলকাতার রক্সি সিনেমা হলের যাত্রা
এহেন অভিনয় পাগল মানুষটি ছোটোবেলায় হতে চেয়েছিলেন কনসার্ট পিয়ানিস্ট। বাড়ির পরিবেশ ছিল পাশ্চাত্য ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। বাবা ছিলেন ইংরেজ কারাগারের জেলার তথা ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক। একটা মিলিটারি নিয়মকানুন ছোটো থেকেই দেখে আসছিলেন তিনি। সেটা ভবিষ্যতে কাজেও দিয়েছিল। সময়কে চিনতে শিখিয়েছিল। মা, দাদা সবার হাতে হাতে শেক্সপিয়র। সেই রক্ত ছোট্ট উৎপলের মধ্যেও ঢুকবে না, তা কি হয়! মাত্র ছয় বছর বয়সেই শেক্সপিয়রের নাটকের সংলাপ হুবহু মুখস্থ বলতে পারতেন। সেই সঙ্গে এসেছিল গান। তখনই ঝোঁক পিয়ানোর দিকে। কিন্তু বাধ সাধলেন শিক্ষিকা মিসেস গ্রিনহল।
আরও পড়ুন
‘এসবই ওঁর বুজরুকি’ – রামকৃষ্ণকে প্রথমবার দেখে বলেছিলেন গিরিশ ঘোষ
অবশ্য নাটক যে একেবারেই জড়িয়ে ছিল না, তা নয়। পেশাদার থিয়েটার দেখা শুরু বাবা-মায়ের সঙ্গেই। হাত ধরাধরি করে যেতেন স্টার থিয়েটার, শ্রীরঙ্গমে। পরে সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে যখন পড়ছিলেন, নিজেও অভিনয় করতে শুরু করেন। অবশ্যই বিদেশি নাটকে। আস্তে আস্তে যেন একটা বড়ো জগত তৈরি হচ্ছিল তাঁর মধ্যে। সেখানে আছেন শেক্সপিয়র, আছেন মার্ক্স, লেনিন; অন্যদিকে আছেন রবীন্দ্রনাথ, শিশির ভাদুড়ি। সব মিলিয়ে একটা বিশাল সাম্রাজ্য যেন তৈরি হয়েছে উৎপল দত্তের চারপাশে। আরও নতুন নতুন ঢেউ আসছে সেখানে।
আরও পড়ুন
কফিশপের মধ্যেই অভিনয়, কলকাতায় থিয়েটারের নতুন সংজ্ঞা বুনছে এই নাট্যগোষ্ঠী
১৯৪৭ সাল। ভারতের স্বাধীন হওয়ার সময়। উৎপলও তখন কলেজে উঠেছেন। আঠেরো বছর বয়স। এমন বয়স, যার তেজ, গরিমা সমস্ত দিক ভরিয়ে রাখে। উৎপল দত্তের ভেতরেও তৈরি হচ্ছিল নিজস্ব ভাবনার জগত। বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করেন নাটকের দল; নাম ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিরিয়নস’। নাম যাই হোক, ভেতরে ভেতরে তাঁরা সবাই উত্তাল। সমাজও তখন ভয়ংকর জায়গায়। দাঙ্গা, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, উদ্বাস্তু— সবাই যেন প্রখরভাবে বাস্তব। একে অস্বীকার কী করে করবেন! তবে এখান থেকেই উত্তরণেরও শুরু। উৎপল দত্তের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে জিয়োফ্রে কেন্ডাল তাঁর নিজের নাট্যদলে ডেকে নেন তাঁকে। সেখানেই আলাপ জেনিফারের সঙ্গে।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সঙ্গে গেছেন বার্লিনে, ছোটোদের জামা পরে বেরিয়ে এলেন রবি ঘোষ
পঞ্চাশের দশক আন্দোলনের দশক। অন্তত এর শুরুটা এই সময় দেখেছিল বাংলা। তৈরি হয়েছিল পিপলস থিয়েটার, গণনাট্য। সেই প্রভাব এসে পড়ল উৎপলের ওপরও। নিজের দলের নাম বদলে দিলেন। নাম হল ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। আস্তে আস্তে এখানে যোগ দিলেন রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়রা। প্রথম নাটক হেনরিক ইবসেনের ‘গোস্টস’-এর বঙ্গানুবাদ। গণনাট্যেও যোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু সেই সম্পর্ক বেশি স্থায়ী হয়নি। নাটক তাঁর কাছে তখন মঞ্চের শৌখিন বিনোদন নয়, প্রতিবাদের ভাষা। ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন।’ মঞ্চ থেকে নাটক নেমে এল রাস্তার মোড়ে। পথনাটিকার শুরুটা করে গিয়েছিলেন এই উৎপল দত্তই। শিখিয়েছিলেন লড়ে যেতে, নিজের আদর্শ থেকে কখনও চ্যুত না হতে। সর্বোপরি, হাতটাকে মুঠো করে রাখতে। ১৯৫১ সালে বাংলা দেখল প্রথম পথনাটক। উমানাথ ভট্টাচার্যের লেখা ‘চার্জশিট’। অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত, পানু পাল, আর ঋত্বিক ঘটক।
আরও পড়ুন
তৈরির ২৫ বছর পর মুক্তি পেয়েছিল প্রথম ছবি, নিজেকে ‘ফ্লপ ডিরেক্টর’ বলতেন ঋত্বিক
দুই বছর আগেই অবশ্য উৎপল-ঋত্বিকের আলাপ হয়ে গিয়েছিল। গণনাট্যের নাটক ‘নবান্ন’-তে বৃদ্ধ কৃষকের ভূমিকায় অভিনয় করলেন ঋত্বিক ঘটক। মেকআপ না তুলেই চলে গেলেন উৎপল দত্তের কাছে। এদিকে উৎপল পড়লেন বেকায়দায়! এ কে? দিনকাল ভালো নয়, আজেবাজে লোক হলে! চিনতে পারলেন না ঋত্বিককে; তাড়িয়ে দিলেন।
আরও পড়ুন
বিলুপ্তপ্রায় বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রতিনিধি তিনি, পদ্মশ্রী পেলেন ৮১ বছরের মণিলাল নাগ
বিদেশি সাহিত্য চষে খেয়েছেন। নিজের ভাষাও অবহেলা করেননি এতটুকুও। বরং মাথায় করে রেখেছিলেন। ইংরেজি উচ্চারণও ছিল চোস্ত। অন্য নাটকের অনুবাদও যেমন করেছেন, তেমনই নিজেই লিখেছেন নাটক। ‘টিনের তরোয়ালের’ কথা কি এভাবে বলে শেষ করা যাবে? নাটক, পথনাটিকা— এসবের বাইরেও তাঁর মতাদর্শ বেরিয়ে আসে বড়ো পর্দাতেও। মনে পড়ে ‘আগন্তুক’ সিনেমার মনমোহন মিত্রের কথাগুলো? ঈশ্বর সম্পর্কে, ধর্ম সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে তাঁর মতবাদগুলো? সেটা কি উৎপল দত্তের নিজের প্রতিচ্ছবিই নয়? কিংবা হীরক রাজা হয়ে যখন সংলাপগুলো বলছেন, তখন মনে মনে ওই সিংহাসনে থাকা মানুষগুলোকেই কঠোর আঘাত করছেন না?
আরও পড়ুন
গুপী-বাঘা থেকে শুরু, ছিলেন সত্যজিতের ছায়াসঙ্গী, প্রয়াত আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষ
আদ্যোপান্ত নাটক-পাগল, প্রখর রাজনৈতিক বোধ সম্পন্ন একজন মানুষ। কিন্তু রসবোধের কমতি ছিল না। শেষের দিকে বলতেন, “ষাট বছর বয়স হলে বিপ্লবী আর বিপ্লবী থাকে না।” জেল খেটেছেন, দাপিয়ে লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। নিজেকে প্রকাশ করতে হবে তো! কথাগুলো তো বলে যাওয়া চাই! নয়তো আর কে বলবে। মোটা মোটা বইয়ের মাঝে তাই রাস্তার দিকে তাকাতেও ভুলতেন না। রবি ঘোষের কথায়, “উৎপল দত্ত ছিলেন সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ স্টেজ স্টলওয়ার্ট।” ৬৪ বছরের ‘স্বল্প’ জীবনে আর যাই হোক না হোক, বাঙালির হাতে একটা টিনের তরোয়াল ধরিয়ে গেছেন উৎপল দত্ত।
ঋণ—
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘লাল দুর্গের অতন্দ্র প্রহরী নট, নাট্যকার ও পরিচালক উৎপল দত্ত’
২) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘বারে বারে পথ দেখান’
৩) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘ঋত্বিককে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন উৎপল দত্ত’
Powered by Froala Editor