আজও রাজধানীর প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পাশাপাশি বসে থাকেন দুজন। কথা বলতে বলতে ফিরে যান ফেলে আসা দিনগুলোতে। সেইসব সময়ে, যখন তাঁরা একে অপরের পাশাপাশি বসার সুযোগ পাননি। দুজন দুই পৃথক ধারার রাজনীতিতে ভেসে গিয়েছেন। একজন ছিলেন কট্টর সমাজতন্ত্রী, আর অন্যজন কট্টর ইসলামপন্থী মুজাহিদিন। অথচ জীবন তাঁদের মিলিয়ে দিয়েছে এক মোহনায়। আজ দুজনের একটাই পরিচয়, তাঁরা আফগানিস্তানের রাজধানী শহর কাবুলের ফুটপাতে বসে বই বিক্রি করেন। ‘বইবিক্রেতা’ – এই পরিচয়টাই আজ বেঁধে রেখেছে শামস-উল-হক এবং হাজি সেহরাজুদ্দিনকে।
ষাটোর্ধ্ব শামস-উল কাবুল বাজারের কাছে বই বিক্রি করছেন ৯০-এর দশকের গোড়া থেকেই। তিনি বিক্রি করেন মূলত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জীবনী এবং ইতিহাস বই। সেখানে তাকে মুজাহিদিন কমান্ডার আহমদ শাহ মাসউদের জীবনীর পাশেই রাখা থাকে আফগানিস্তানের শেষ কমিউনিস্ট শাসক মহম্মদ নাজিমুল্লার জীবনী। আবার হিটলারের ‘মেইন ক্যাম্ফ’-এর পাশেই থাকে চে গুয়েভারার ডায়রি। কিছুদিন পরেই তাঁর পাশে দোকান দিলেন সেহরাজুদ্দিন। তাঁর দোকান অবশ্য মূলত পাঠ্যবইয়ের। শামস-উলের কথায়, রীতিমতো মুজাহিদিনের মতোই এসে জায়গা দখল করলেন। প্রাথমিক বাদানুবাদের পর্ব পেরিয়ে অবশ্য যোগাযোগ সহজ হতে সময় লাগেনি।
আশির দশকে আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের বিমান বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলেন শামস-উল। দলের সদস্য অবশ্য তিনি ছিলেন না, কিন্তু ১৯৭৮ সালের কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের সময় তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, মোহম্মদ দাউদ খানের শাসনে অতিষ্ট মানুষের তখন রাশিয়ার সামরিক অভিযানকে আশীর্বাদ বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েতে ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গেই আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের ক্ষমতা বিস্তার শুরু হয়ে গেল। ঠিক এই সময় সেহরাজুদ্দিন যোগ দিয়েছিলেন সশস্ত্র মুজাহিদিন বাহিনীকে। তাঁর পরিবারের অনেকে কমিউনিস্ট শাসনে কারাবাস করেছেন, অনেকের মৃত্যু হয়েছে। সেইসব ক্ষত তখনও মনের মধ্যে জীবন্ত। কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয় বাদ দিলে আজ তাঁর মনে হয়, তিনি ভুলই করেছিলেন। আসলে মুজাহিদিনদের ব্যর্থতাই তো তালিবানদের ক্ষমতা বিস্তারের জায়গা তৈরি করে দিল।
আজও বিক্রিবাটার মধ্যে দুজনের কথায় কথায় উঠে আসে সেইসমস্ত দিনগুলো। আর চোখের সামনে দেখছেন আরও একটা যুদ্ধ। যখন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা অপসারনের পর নতুন করে ক্ষমতা বিস্তার করছে তালিবানরা। এই মুহূর্তে দেশের ৭০ শতাংশ এলাকা তালিবানদের দখলে। আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী, জানেন না শামস-উল বা সেহরাজুদ্দিন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আর তাঁদের কাছে ভবিষ্যৎ বলে কিছুই পড়ে নেই। আছে শুধু ফেলে আসা স্মৃতি।
আরও পড়ুন
স্বর্ণপদক ভাগ করে নিলেন দুই প্রতিযোগী, বিরল বন্ধুত্বের সাক্ষী অলিম্পিকের মঞ্চ
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
যুদ্ধের বিপরীতে অস্ত্র বই! অরুণাচল সীমান্তে ছাত্রদের হাতেই জন্ম নিচ্ছে লাইব্রেরি