দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো একটি বোর্ড। তাতে আঁকা রয়েছে মানুষের প্রতিকৃতি। সেই বোর্ডে ঠেস দিয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছেন লালমোহন গাঙ্গুলি, ওরফে জটায়ু। আর তাঁর ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে অর্জুন। মগনলাল মেঘরাজের হুকুম পেয়েই একের পর এক ছুরি নিক্ষেপ করছেন তিনি জটায়ুর দিকে। অথচ, আঁচড়টুকু পড়ছে না তাঁর শরীরে। দেহ থেকে ইঞ্চি খানেক দূরে গিয়ে গেঁথে যাচ্ছে বোর্ডে। অব্যর্থ লক্ষ্য যাকে বলে।
সত্যজিতের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির এই দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত নন, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সে-যুগে বাংলা চলচ্চিত্রে স্পেশাল এফেক্টের সুযোগ-সুবিধা নেই। ফলে ছবিতে এই বিশেষ দৃশ্যটিকে রাখার জন্য সত্যিকারের স্টান্টম্যানের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল সত্যজিৎ-কে। ছবিতে অর্জুনের ভূমিকায় কামু মুখোপাধ্যায়কে অভিনয় করতে দেখা গেলেও, আদতে ছুরির এই ভয়ঙ্কর খেলাটি দেখিয়েছিলেন বাঙালি জাগলার অভয় মিত্র। যাঁর মাদারির খেলা দেখে বহু আগেই মুগ্ধ হয়েছিলেন খোদ সত্যজিৎ।
তবে মজার বিষয় হল, অভয় মিত্রের এই ছুরির খেলা দর্শকদের মুগ্ধ করে দিলেও, অভয় মিত্র নিজে মনে করতেন এই খেলায় ততটাও পারদর্শী নন তিনি। তবে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ অভয় মিত্রের আত্মপ্রকাশের বহু আগেই, সিনেমার পর্দায় একাধিকবার এই স্টান্ট দেখিয়েছিলেন অন্য একজন স্টান্টম্যান। ছুরি ছুঁড়ে লক্ষ্যভেদ করার ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে অপরাজেয় তিনি, এমনটা মনে করতেন অনেকেই। এমনকি স্বয়ং অভয় মিত্রও। কিন্তু কে তিনি?
জর্জ ই ‘স্কিটার’ ভগান (George E Skeeter Vaughan)। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতে যিনি পরিচিত ‘গ্রেট অটার’ (The Great Otter) নামে। সবমিলিয়ে প্রায় ১০০টিরও বেশি চলচ্চিত্র, টেলিভিশন শো এবং বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন জর্জ। তাছাড়াও তাঁবু পেতে ছোট্ট সার্কাসও খুলে ফেলেছিলেন তিনি। তাঁর ছুরি নিক্ষেপের খেলা দেখতে প্রতিদিন সেখানে হাজির হতেন শতাধিক মানুষ। কিন্তু তাঁর এই আশ্চর্য লক্ষ্যভেদের ক্ষমতার রহস্য কী? কীভাবে এই খেলা আয়ত্ত করেছিলেন তিনি?
অভয় মিত্র যেমন কৈশোরবেলা থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন জাগলিং ও অন্যান্য খেলার, জর্জের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন নয়। বলতে গেলে তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাপনই এই আশ্চর্য ক্ষমতা উপহার দিয়েছিল তাঁকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ-ইস্টার্ন উডল্যান্ডে বসবাসকারী চেরোকি উপজাতির মানুষ ছিলেন তিনি। অরণ্যে শিকার করেই কৈশোর কেটেছে তাঁর। ছুরি নিক্ষেপ করে লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা সেখান থেকেই পেয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে ষাঁড় বা বন্য মহিষ শিকারের সময় সরাসরি চোখে ছুরি মারতেন তিনি।
১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। সেনার চাহিদা তুঙ্গে। সে-সময় নতুন আইন করে শ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি কৃষাঙ্গদেরও সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেই খবর পেয়ে ১৯৪৪ সালে সেনার নিজের নাম খাতায় তালিকাভুক্ত করেছিলেন জর্জ। তারপর পাড়ি দেওয়া ইউরোপে। তবে বিশ্বযুদ্ধের ময়দয়ানেও বন্দুকের বদলে ছুরি ব্যবহার করে একাধিক নজির গড়েছিলেন তিনি।
মার্কিন সেনাবাহিনীর নথিতেই উল্লেখ পাওয়া যায় এমন একটি ঘটনার। ১৯৪৪ সালের জুন মাস। জর্জকে পাঠানো হয়েছিল সিগফ্রাইড লাইনে অবস্থিত একটি জার্মান বাঙ্কার দখল করার জন্য। উল্লেখ্য, সেটাই ছিল তাঁর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। অবশ্য জর্জ একা নন, সঙ্গে ছিলেন আরও ৫ সহকারী সৈন্য। তবে ঘটনাস্থলে পৌঁছে জর্জ দেখেন বাঙ্কারের বাইরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সশস্ত্র জার্মান প্রহরী। তাঁকে হত্যা করে তবেই প্রবেশ করতে হবে বাঙ্কারে। এদিকে গুলিও চালানো যাবে না। বন্দুকের আওয়াজে পেলেই সতর্ক হয়ে যাবে বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকা অন্যান্য সৈন্যরা। লোকবলেও তারা অনেক বেশি। গোলা-বারুদেরও অভাব নেই তাদের কাছে। সমাধান হিসাবে তাই ছুরিকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ঝোপের আড়াল থেকে এক ছুরিতেই বিদ্ধ করেছিলেন পাহারারত জার্মান প্রহরীকে। সোজা কপালের মাঝে গেঁথে দিয়েছিলেন বন্দুকের বেয়োনেট। টুঁ শব্দটিও করতে পারেনি উল্টোদিকের জার্মান প্রহরী।
তাঁর ঊর্ধ্বতন মেজর এবং সতীর্থদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৯ গজ বা ৮৭ ফুট দূর থেকে বেয়োনেট নিক্ষেপ করেছিলেন জর্জ। এখনও পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে সর্বাধিক দূরত্ব অতিক্রম করা ছুরিকা নিক্ষেপের নিদর্শন এটিই। বাস্তবেও মঞ্চে খেলা দেখানোর সময় দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি ছুরি ছুঁড়ে এত দূরত্ব অতিক্রম করেছেন কিনা, সন্দেহ আছে তা নিয়েও। তবে মজার বিষয় হল, কথিত আছে নিজের তাঁবুতে খেলা দেখানোর সময় নাকি কখনও কখনও ৩৫ গজ দূরত্ব থেকে ছুরি ছুঁড়তেন ‘দ্য গ্রেট অটার’। এই তথ্য আদৌ সত্যি কিনা, তা নিশ্চিত নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তা পরিমাপও করা হয়নি কোনোদিন। তবে অস্বীকার করার জায়গা নেই, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন মুলুক এবং ইউরোপে ছুরিকা নিক্ষেপের খেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তাঁর হাত ধরেই। প্রশ্ন থেকে যায়, তাঁর এই বিশেষ শিল্পকর্মই কি ‘অর্জুন’ চরিত্রটি তৈরি করতে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিল সত্যজিৎকে? জানা নেই সেই উত্তর…
Powered by Froala Editor