গড়গড়ার শব্দে চমকে দিয়েছিলেন সাহেবদের, বিস্মৃতির অতলে প্রথম বাঙালি বিলেতযাত্রী

অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইংরেজরা। তামাক খাওয়ার অভ্যাস তাদের ছিল ঠিকই কিন্তু তাই বলে এমন হুপ হুপ শব্দের হুঁকোয় টান! এতো অবাক করবেই। আর তাই কৌতুহল মেটাতে এই বস্তুটি দেখতে ভিড় জমাতে থাকে অনেকেই।

সময়টা ১৭৬৬ সাল। লন্ডনের মাটিতে খোদ দেশি কায়দায় সুসজ্জিত বাহারি নলে ধোঁয়া ওড়াচ্ছেন কোনো এক পাগড়ি মাথার চোগা-চাপকান পড়া বাঙালি। হ্যাঁ, ইনি  বাঙালি। তবে ইনি রামমোহন রায় নন, রামমোহনের প্রায় ৬০ বছর আগেই লন্ডনে যাত্রা করেন ইতেশামুদ্দীন।

বাঙালি আজকাল হামেশাই বিদেশ যায়। ঘরে ঘরে পাসপোর্ট, ভিসা। তবুও আজকের দিনে দাঁড়িয়েও বিদেশ ফেরতা বাঙালির দর এক নিমেষে বেশ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।  আর সেখানে ইতেশামুদ্দীন ছিলেন প্রথম  বাঙালি যিনি বিদেশ যাত্রা করেন। বিদেশে বাঙালি এই খেতাবই বোধ হয় যথেষ্ট ছিল না, অন্য শিরোপাটা তখনও প্রহর গুনছিল। তাঁর এই দুবছরের বিদেশ ভ্রমণ উপহার দিল বাঙালির লেখা প্রথম বিলেত ভ্রমণের কাহিনী, সিগরুফ-ই-বিলায়েতনামা। ফারসি ভাষায় লিখেছিলেন এটি। 

১৭৩০ সালে, বাংলার নদীয়া জেলার পাঁচনুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ইতেশামুদ্দীন। অভিজাত মুসলিম পরিবারের সন্তান মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দীন চেয়েছিলেন মুনশির কাজে যোগ দিতে। তৎকালীন ইংরেজ শাসিত বাংলায় মুনশি হল সম্মানজনক বৃত্তি। আর ফারসি ভাষায় দখল না থাকলে এই বৃত্তি জুটত না। ইতেশামুদ্দীন নবাব মীর জাফরের দরবারের মুনশি সলিমুল্লাহর কাছে ফারসি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন তাই এই চাকরি পেতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি তাঁর। এই সময় তিনি পাটনার মেজর অ্যাডামের অধীনেও চাকরির চেষ্টা করেন। কিন্তুপ অন্য এক বিখ্যাত মুনশি নবকৃষ্ণের চাতুরিতে হাতছাড়া হয়ে যায় এই কাজটি। অন্যদিকে ৬৪-র বক্সার যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভাগ্যের চাকায় মোড় পরিবর্তন ঘটে। কাজের সুত্রে দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ইতেশামুদ্দীনের। নবাবের দৌলতে নতুন চাকরি আর নতুন খেতাব দুইই জুটল তাঁর। শাহী দরবারের মুনশির পদ পেলেন, পাশাপাশি মির্জা খেতাবও। রাতারাতি ভাগ্যদেবতার প্রসাদে সভাসদ হয়ে উঠলেন তিনি। আর সেই পথ আর একটু বাড়িয়ে দিলেই সেটা সোজা লন্ডনে পাড়ি দেয়। 

আরও পড়ুন
প্রথম বাঙালি হিসেবে রেলগাড়িতে চড়লেন রামমোহন রায়, খবর বেরোল সংবাদপত্রেও

কোম্পানির তৎকালীন এক কর্মকর্তা সুইনটনকে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের জন্য বাদশার চিঠিসহ শাহি দূত হিসেবে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিলেতের রাজদরবারে ফারসি ভাষায় লেখা চিঠি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য বাদশা নিজেই ইতেশামুদ্দীনকে নির্বাচন করেন। ১৭৬৬ সালে তাঁকে দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সুইনটনের সঙ্গে লন্ডন পাঠিয়ে দিলেন বাদশা। 

আরও পড়ুন
ভারতের হয়ে টেস্ট খেলা দ্বিতীয় বাঙালি তিনি, প্রথম ম্যাচেই ৫ উইকেট নিয়ে চ্যালেঞ্জ প্রতিপক্ষকে

এরপর কি ঘটেছিল? ওই যে প্রথমেই বললাম দেশি কায়দায় হুঁকোর টান চমকে দিয়েছিল সাদা চামড়ার মানুষদের। না শুধু এটুকু নয়, আরো অনেকটাই ঘটেছিল। কেন পাঠানো হয়েছিল তাঁকে, কতটা নিয়ম মেনে কাজ করেছিলেন তিনি, কিংবা প্রথম বিদেশ ভ্রমণ কিভাবে এদেশ বিদেশ কে মিলিয়ে দিয়েছিল তার সবকটা উত্তর তিনি রেখে যান বাঙালির লেখা প্রথম ভ্রমণকাহিনি বিলায়েতনামায়। ১৭৬৫ সাল, বাদশাহ শাহ আলম বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিলেন। কাহিনীটি শুরু হয়েছে ঠিক এইখান থেকেই। সঙ্গে দিলেন একটা গালভরা উপাধিও, 'সাবিৎ জঙ্গ'। “বাদশা চোখে পানি নিয়ে ক্লাইভকে বললেন, ‘আপনার মনমতোই আপনি কোম্পানির স্বার্থ হাসিল করেছেন। কিন্তু আমার শাসনকে মজবুত করতে কিছুই করেননি। দিল্লির সিংহাসন থেকে যেন আমি নির্বিঘ্নে শাসন চালাতে পারি, সেজন্য ইংরেজ সেনা মোতায়েন করার কোনো পদক্ষেপই আপনি নেননি। এখন বিশ্বাসঘাতক আর ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন আপনি...।’ এলাহাবাদ চুক্তির শেষে ফেরার আগের এই ঘটনাকে দিয়েই লেখা শুরু করেন ইতেশামুদ্দীন।

আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম ফারসি সংবাদপত্র বেরোল কলকাতা থেকে, প্রকাশক রাজা রামমোহন রায়

দেশীয় নবাবদের এবং রাজাদের দমন করে ব্রিটিশ শক্তির সহযোগিতায় মোঘল সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাকে ঘুরে দাঁড় করাতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা সফল হয়নি। ইতেশামুদ্দীনকে পাঠানো হয়েছিল দুই রাজশক্তির মধ্যে মৈত্রী স্থাপনের উদ্যেশে। সফল হয়নি সেই কাজও। বরং সময়ের চাকা সেদিন বলেছিল, পরাধীনতার দু'শো বছর শিয়রে কড়া নড়ছে। যদিও পরেই তিনি জানতে পারেন সেই চিঠি আদেও তাঁর যাত্রা সঙ্গী সুইনটনের কাছে ছিল না। আর এখানেই ইতেশামুদ্দীনের ভাগ্যের মোড় বদলায় আবার। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর এই সফর কেবলমাত্র চোখে ধুলো দেওয়ার পরিকল্পনা। ফলে তিনি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু দেশে ফিরে যাতে এই ভ্রমণকাহিনি লিখতে পারেন তাঁর রসদ সংগ্রহ করতে ভুল করেননি। যাত্রার প্রকৃত উদেশ্য সফল না হলেও বাঙালি হিসেবে নিজের ছাপ স্পষ্ট করতে তিনি পেরেছিলেন। 

আরও পড়ুন
প্রথম রেলপথের পরিকল্পনা করেছিলেন দ্বারকানাথ, আমরা কি মনে রেখেছি সেই কথা?

বিলায়েতনামা লেখা হয় মির্জার দেশে ফেরার পনেরো বছর পরে— ১৭৮৪/৮৫ সালে। বইটির একদিকে ছিল বিলেতের সমাজ, প্রতিষ্ঠান, জীবনযাত্রার বিবরণ, আর অন্যদিকে ইউরোপ ভার্সেস ভারত জীবনের তুলনা। মারাঠা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের উল্লেখ করেছিলেন তিনি। বইয়ে সন-তারিখ লেখার সময় ইতেশামুদ্দীন হিজরি মাসের পাশাপাশি বাংলা মাসের নামও দিয়েছেন। বিলেত থেকে ফেরা প্রথম বাঙালিকে তখন লোক বলতে থাকে বিলায়েত মুনশি। লোকমুখে পাওয়া এই উপাধিটুকুই সব, কারণ কোম্পানির কাছ থেকে পদোন্নতি বা পুরস্কার কোনোটাই জোটেনি তাঁর। আর তাই লেখাতেও ফুটে ওঠে তাঁর জীবনের অভাব চিত্র।

আরও পড়ুন
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ, কলকাতার বুকেই তৈরি ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা

 তিনি বাঙালি কিনা সে নিয়েও বেশ কিছু জল্পনা ওঠে, তবে অচিরেই তা হারিয়ে যায়। তিনি বাঙালি একথা সত্যই। অধ্যাপক কায়সার হকের মতে, আনুমানিক ১৮০০ সালে মারা যান প্রথম বাঙালি বিদেশ যাত্রী। সেদিন কোম্পানি তাঁকে হতাশ করেছিল ঠিকই কিন্তু বাঙালি তাকে আজও মাথায় করে রেখেছে। বাঙালির এই সুযোগ পেলেই বিদেশ ভ্রমণের বীজ পোঁতা হয়তো তখনই হয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন
প্রথম বাঙালি যুদ্ধবিমান চালক তিনি, মৃত্যুর আগে ধ্বংস করেছিলেন শত্রুপক্ষের ৯টি বিমান

তথ্যসূত্র : বিলায়েতনামা—মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দীন, আবু মহামেদ হাবিবুল্লাহ, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৮১।
কাউন্টার ফ্লোম টু কলোনিয়ালিজম—মাইকেল এইচ ফিসার, পারমানেন্ট ব্লাক, দিল্লি, ২০০৪।

Powered by Froala Editor