গল্পের শুরুটা হোক শশী কাপুরকে দিয়ে। বলিউডের নায়ক শশী কাপুর। কলকাতায় এসেছেন সিনেমার কাজে। এখানে এসে তো আর যেমনতেমন জায়গায় থাকতে পারেন না। বেছে নিলেন সদর স্ট্রিটের একটি হোটেল - ফেয়ারলনকে। হোটেলের ১৭ নম্বর ঘরে শশী কাপুরের বাস। কলকাতায় আরো আলিশান থাকার জায়গা তখন নেহাৎ কম ছিল না। তবু, বড়ো রাস্তা থেকে খানিক ভেতরে এই হোটেলই পছন্দ হল তাঁর। শুধু পছন্দ হয়েছিল তা নয়, ফেয়ারলন জুড়ে গিয়েছিল তাঁর গোটা জীবনে। এখানেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ জেনিফার কেনডেলের। প্রেম থেকে বিবাহ। বিবাহের পর ফের ফিরে আসা এই হোটেলে। যেন বৃত্ত সম্পূর্ণ করা। পরে, একটি বিখ্যাত ছবির সূত্রেও এই হোটেলে আসেন শশী কাপুর। ছবির নাম 'শেক্সপিয়রওয়ালা'। ১৯৬৫ সালে মুক্তি-পাওয়া জেমস আইভরি ও ইসমাইল মারচেন্টের ছবি। সঙ্গীত পরিচালক সত্যজিৎ রায়৷ জনমানসে খানিক বিস্মৃত হলেও ফেয়ারলনে সে ছবি আজও টাটকা। পুরোনো কলকাতা, বদলে-যাওয়া কলকাতার এমনই নানা টুকরো স্মৃতি নিয়ে সদর স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আছে এলগিন ফেয়ারলন হোটেল। বয়স প্রায় আড়াইশো বছর।
কলকাতা শহরে হোটেলের অভাব নেই। অভাব নেই হোটেল-ঘিরে গল্পেরও। স্পেনসেস থেকে শুরু করে গ্র্যান্ড। চৌরঙ্গী থেকে হালফিলের শাহজাহান রিজেন্সি। হোটেল আছে, তাকে ঘিরে অবান্তর স্মৃতি আছে। খুঁজলে অশ্রু-ঝলমল মুখও আছে। হোটেলের একেকটি ঘরই হয়ে উঠতে পারে একেকটি গল্পের আখ্যান। সদর স্ট্রিটের এলগিন ফেয়ারলন হোটেল এমনই অনেক গল্পের আখ্যান বুনে চলে।
কলকাতা- 'দ্য সিটি অব জয়'। ফরাসি লেখক ডোমিনিক লেপিয়ের-এর লেখা উপন্যাস। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস জুড়ে কলকাতা কলহাস্যে মুখর। এই উপন্যাসের পর থেকেই নাকি এই বিশেষণে চিহ্নিত হতে থাকে আমাদের শহর। উপন্যাস লেখার জন্যে শহরে এসে ফেয়ারলন হোটেলটিকেই বেছে নিয়েছিলেন লেখক। ১৯৯২ সালে এই উপন্যাস থেকে সিনেমা। তখন অভিনেতা প্যাটরিক সোয়াজও থেকেছিলেন এই হোটেলে।
ভ্রমণকাহিনি লেখক এরিক নিউবাই বেশ কিছুদিন অতিথি ছিলেন এই হোটেলের। এরকমই অনেক খ্যাতনামা অতিথি-অভ্যাগতদের স্মৃতিতে ভরপুর এলগিন ফেয়ারলন হোটেল। অন্যান্য খ্যাতনামা হোটেলের যে বাহ্যিক চাকচিক্য, যে অকারণ কেতা - তা এখানে অন্তত নেই। প্রবেশ করতে বুক দুরুদুরু করে না।
আরও পড়ুন
লকডাউন শেষে উদ্বোধন সোনার হোটেল, পর্যটক টানতে উদ্যোগ ভিয়েতনামে
সদর স্ট্রিট এমনিতে কলকাতার বৈচিত্রে-ভরা রাস্তাগুলির মধ্যে অন্যতম। শহরের কসমোপলিটান চেহারা এ-রাস্তায় উজাড় হয়। নানাদেশের বহুভাষা মিলেমিশে যায়। বড়ো রঙিন এ রাস্তার ছবি। ইতিহাস রাস্তার দুপাশ ধরে বরাবর চলে গেছে। একদিক রয়েছে জাদুঘর। সেখানেই কোথাও মুখগুঁজে আছে সেকালের সদর কোর্টটি। তবে রাস্তার থেকেও প্রাচীনতর ফেয়ারলন হোটেলের এই বাড়িটি। ১৭৮৩ সালে উইলিয়াম ফোর্ড নামে এক সাহেব বানিয়েছিলেন বাড়িটি। তারপর বহুবার হাত বদলেছে অবশ্য। ১৯৩৬ সাল থেকে হোটেল। অবশ্য মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে বছর দুয়েকের জন্যে কানাডার বায়ুসেনার বাসস্থান হয়েছিল। তারজন্যে নামও হয়েছিল কানাডা হাউজ। তারপর আবার হোটেল-রূপে প্রত্যাবর্তন।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর স্মৃতি সর্বাঙ্গে, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ লেখার ঠিকানা আজ সাধারণ এক হোটেল
আজ হয়তো বহিরঙ্গের নকশা খানিক বদলেছে। কিন্তু মূল কাঠামোটি একই থেকে গেছে। লোহার গেট খুলে এগোলেই একটা অন্যসময় অভ্যর্থনা জানায়। প্রাচীন আসবাব, আলমারি, আয়না, পুরোনো মডেলের সিলিংপাখা, আলোয় সাজানো টি-লাউঞ্জ। একুশ শতকের হট্টমেলাটা ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে। সোফায় বসে আপনি এবার ভাবতেই পারেন, আঠেরো শতকের কথা। ফ্যানি পার্কসের কলকাতার কথা। নদী তখন শহরের অনেক কাছ দিয়ে বইত।
আরও পড়ুন
স্পেনসেস থেকে গ্র্যান্ড— কেমন ছিল কলকাতার পুরনো হোটেলগুলি?
'শেক্সপিয়রওয়ালা' চলচ্চিত্রটির কথায় ফেরা যাক। ইংরেজি ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের সুর দেওয়ার ঘটনা আমরা কজনই বা মনে রেখেছি! সেদিক থেকে সিনেমাটি অনন্য তো বটেই। অনন্য কাহিনির বিচারেও। স্বাধীনতার পর বদলে-যাওয়া ভারতবর্ষের ছবি উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে। প্রাচীন জমিদার কীভাবে হোটেলের ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন- 'শেক্সপিয়রওয়ালা'- সে গল্প শোনায়। কোথাও এই বদলের পাশে রেখে ফেয়ারলনকে দেখা যায়। তার বদল হয়নি এমন নয়। ২০১৮ সালে এলগিন গ্রুপের আওতায় এসে, ফেয়ারলন, এলগিন ফেয়ারলনে পরিণত হয়। কিন্তু তাতে তার চরিত্র বদলায়নি। আভিজাত্যে টান পড়েনি। আজকাল কলকাতায় পাঁচতারা, সাততারা হোটেলের ভিড়। মহার্ঘ সেসব হোটেলের শিকড় নেই, আর থাকলেও বাজারের তাড়নায় তা প্রায় লুপ্ত। কিন্তু সদর স্ট্রিটের এই হোটেল জনারণ্যে মিশেই নিজের আভিজাত্য ও শিকড়কে বজায় রেখেছে আজও। চারপাশে অগম্যতার পাঁচিল তুলে নিজেকে সরিয়ে নেয়নি। তাই আজও সে কলকাতার একান্ত নিজের হয়ে আছে।
Powered by Froala Editor