কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক যুবক। ক্লান্ত, শীর্ণ, উজ্জ্বল মুখে এসে পড়েছে দারিদ্র্যের ছায়া। একটা সামান্য চাকরির জন্য শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু প্রতিটা চেষ্টাই বিফল হচ্ছে। রাস্তায় বসে পড়ছেন যুবক নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ হওয়ার আগেই জীবনের দুঃখ, মৃত্যু, বেকারত্ব গ্রাস করেছিল। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই তাঁকেও অনিশ্চিতের মুখে ফেলেছিল।
যতদিন বাবা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন, ততদিন পরিবারের ওপর দিয়ে কোনও ঝড় বয়ে যায়নি। এলেও, বিশ্বনাথ দত্ত একা সামলে নিতেন সেসব। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পরই সমস্ত ছবিটা বদলে গেল। উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলের বাড়িটা নিয়ে আত্মীয় পরিজনরা গোলযোগ বাঁধাল। এছাড়াও দত্ত পরিবার তখন ঋণে জর্জরিত। সংসারে মা ছাড়াও আরও দুটি ভাই রয়েছে। বাধ্য হয়ে চাকরির খোঁজে রাস্তায় নামলেন বিবেকানন্দ, তখন অবশ্য তিনি নরেন্দ্রনাথ।
কিন্তু সে সময়ের কলকাতায়ও একটি সাধারণ চাকরি জোগাড় করা ছিল দুঃসহ ব্যাপার। নরেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। সমস্ত অফিসে আবেদনপত্র নিয়ে যাচ্ছেন, আর খালি হাতে ফিরে আসছেন। এমন অবস্থায় ১৮৮৪ সালে একটি কাজ জুটল। ‘শ্রীম’ মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর চেষ্টায় সুকিয়া স্ট্রিটের মেট্রোপলিটন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেন নরেন। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এখানকার প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু বেশিদিন সেখানে কাজ করেননি। ওখানকার সেক্রেটারি ছিলেন বিদ্যাসাগরের জামাই। সমস্ত শিক্ষক, হেড মাস্টার সবাই তাঁকে সমঝে চলবে, তাঁর কথা শুনবে, এই তাঁর অভিপ্রায়। কিন্তু নরেন যে অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। ফলত, বিনা কারণে, একপ্রকার সাজিয়েই ছাত্রদের মারফত বিদ্যাসাগরের কাছে খবর পাঠানো হল— ‘নতুন মাস্টার পড়াতে পারেন না।’ বিদ্যাসাগর তখন অসুস্থ। নিজের সমস্যায় নিজেই জর্জরিত। ভালোভাবে খোঁজও নিলেন না এই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে। বললেন, ‘তাহলে নরেনকে বল, আর যেন না আসে’…
যাও বা চাকরি পেলেন, ঠিকঠাক দাঁড়ানোর আগে সেটাও চলে গেল। কোনও কারণ খুঁজে পেলেন না নরেন্দ্রনাথ। তখন তিনি প্রকৃত অর্থেই বিধ্বস্ত। আবারও কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাড়িতে একজনের চাল ডাল বেচে যাবে বলে বেশিরভাগ দিনই বাড়ি ফিরছেন না। অন্য বাড়ির রোয়াকে রাত কাটিয়েছেন। দুপুর রোদে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোস্কা পড়েছে। পরবর্তীকালে, ‘বিবেকানন্দ’ রূপে আবির্ভূত হওয়ার পর এই মুহূর্তগুলোর কথা বলেছেন—
‘মৃতাশৌচের অবসান হইবার পূর্ব হইতেই কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে হইয়াছিল। অনাহারে নগ্নপদে চাকরির আবেদন হস্তে লইয়া মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রে আফিস হইতে আফিসান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম… দেখিতাম, দুই দিন পূর্বে যাহারা আমাকে কোনও বিষয়ে কিছুমাত্র সহায়তা করিবার অবসর পাইলে আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছে, সময় বুঝিয়া তাহারাই এখন আমাকে দেখিয়া মুখ বাঁকাইতেছে…’
এই কদিনে দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেছে নরেনের। আধ্যাত্মিকতার দিকে মনও এসেছে। কিন্তু এমন টালমাটাল সময় ভগবানের প্রতিও যেন বীতশ্রদ্ধ তিনি। নিজেই বলছেন, “দুই-একজন বন্ধু মিলিয়া বসিয়াছিলাম… তন্মধ্যে একজন বোধহয় আমাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য গাহিয়াছিল— ‘বহিছে কৃপাঘন ব্রহ্মনিঃশ্বাস পবনে’… ক্ষোভে, নিরাশায়, অভিমানে বলিয়া উঠিয়াছিলাম, ‘নে, নে, চুপ কর, ক্ষুধার তাড়নায় যাহাদিগের আত্মীয়বর্গকে কষ্ট পাইতে হয় না, গ্রাসাচ্ছাদনের অভাব যাহাদিগকে কখনও সহ্য করিতে হয় নাই, টানাপাখার হাওয়া খাইতে খাইতে তাহাদিগের নিকটে ঐরূপ কল্পনা মধুর লাগিতে পারে… আমারও একদিন লাগিত…”। বেকারত্ব, দারিদ্র্য যে কি জিনিস, নিজে চাক্ষুষ উপলব্ধ করছেন তিনি।
এমন অবস্থায় লোকজনের কুসঙ্গে পড়ে যাওয়ার ভয় তো থাকেই। নরেনের আশেপাশেও তখন ঘুরছে নানা প্রলোভন। তবে সেসব বৃথা প্রলোভন ছিল। কোনদিনও আমল দেননি। এমনকি এও বলা হচ্ছিল, অবস্থার কবলে পড়ে নরেন্দ্রনাথ নাকি ‘দুশ্চরিত্র, নাস্তিক হয়ে পড়ছেন। মদ্যপান ও বেশ্যালয় গমনও বাদ রাখেননি।’ এমন কথা তাঁকে পীড়িত তো করতই, কিন্তু সেই নরেনও একসময় বলতে বাধ্য হয়েছেন, “এই দুঃখ-কষ্টের সংসারে নিজ দুরদৃষ্টের কথা কিছুক্ষণ ভুলিয়া থাকিবার জন্য যদি কেহ মদ্যপান করে, অথবা বেশ্যাগৃহে গমন করিয়া আপনাকে সুখী জ্ঞান করে, তাহাতে আমার যে বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই তাহাই নহে, ঐরূপ করিয়া আমিও তাহাদিগের ন্যায় ক্ষণিক সুখভোগী হইতে পারব…”। দারিদ্র্যের কষাঘাত যে কতটা তীব্র হলে একজন এই কথা বলতে পারে, সেটা যারা এই অবস্থায় পড়েছেন তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন।
মানুষের জীবন পরিবর্তনশীল। অবস্থা কারোরই একরকম থাকে না। একদিন যে নরেন্দ্রনাথ দত্ত কটা টাকার চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, পরে ইনিই হয়ে উঠেছেন যুগাবতার স্বামী বিবেকানন্দ। কিন্তু এই কষ্টের দিনগুলো সবসময় সঙ্গে নিয়ে চলতেন তিনি। আর চলতেন বলেই, মানুষের দুঃখে, বেদনায় নিজেকে যুক্ত করে নিতেন। হয়ে উঠতেন তাঁদের সহায়।
ঋণ – অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ / শংকর
Powered by Froala Editor