প্যারিসে ইংরেজি সাইনবোর্ড, ইংরেজি বইয়ের দোকান। ব্যাপারটা আশ্চর্যই বটে। তবু সে 'আশ্চর্য' বহাল তবিয়তে পার করে ফেলেছে একশোটি বছর। শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি - বইয়ের এই দোকানকে ঘিরে সারা পৃথিবীর বইপ্রেমী মানুষের অপার আগ্রহ। কেউ কেউ বলেন দোকানের ছদ্মবেশে এটি নাকি 'সোশালিস্ট ইউটোপিয়া'। জেরেমি মার্সারের 'টাইম ওয়াজ সফট দেয়ার'- উপন্যাসে রয়ে গেছে এই বুকশপের কথা। এছাড়া 'বিফোর সানসেট' চলচ্চিত্রটিতেও প্রধান ভূমিকায় এই বুকশপ। বইও যে ডিজিটাল হয়ে উঠেছে আজকাল, এই দোকানে দাঁড়ালে তা অবিশ্যি মনে হয় না।
কিন্তু কেন এই বুকশপ আশ্চর্যের? তার কারণ বোধহয় লুকিয়ে আছে তার অপরূপ নামকরণের মধ্যে। 'শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি'- এই পৃথিবীর যারা লেখক, যারা পাঠক, বইয়ের সঙ্গে বা লেখার সঙ্গে যুক্ত মানুষ- তারা সবাই '...এন্ড কোম্পানি'। খুব ভেবেচিন্তেই বুকশপের মালকিন সিলভিয়া বিচ এই নামকরণ করেছিলেন। জন্মসূত্রে অ্যামেরিকান হলেও প্যারিসের প্রতি তাঁর ভালোবাসা চিরকালীন। আর নিবিড় ভালোবাসা সাহিত্যের প্রতি। অনেকেই তাই 'মাদার অফ লিটারেচার' বলে থাকেন তাঁকে। ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে বইয়ের দোকানটি নির্মাণ করেন। সিলভিয়া জানতেন, বই সবার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তাই লেন্ডিং লাইব্রেরি তৈরি হয় একটা। যার সভ্য ছিলেন এজরা পাউন্ড থেকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, পল ভালেরি, গার্ট্রুড স্ট্রাইন ও আরো অনেকে। তখন থেকেই বেশ আলোচ্য হয়ে ওঠে এই দোকানঘরটি।
১৯২০ সালে সিলভিয়ার সঙ্গে আলাপ হয় একজন লেখকের। তিনি জানান, তিনি অত্যন্ত দরিদ্র, নিদারুণ অনটনে আছেন, লেখক হিসেবে তেমন নামডাকও নেই। কিন্তু তাঁর একটি উপন্যাস যদি ছাপানোর দায়িত্ব নেন সিলভিয়া...। সিলভিয়া রাজি। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। নাম 'ইউলিসিস' এবং লেখক জেমস জয়েস। এই উপন্যাসই একসময় বাজেয়াপ্ত ছিল আমেরিকা ও ব্রিটেনে। ওয়াল্ট হুইটম্যানের 'লিভস অফ গ্রাস'ও শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানির প্রকাশনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দোকানটি বন্ধ করতে বাধ্য হন সিলভিয়া। তাতেও অবশ্য একটা গল্প আছে। প্যারিসে তখন জার্মান সেনার দাবরাব। একদিন এক জার্মান সেনাপ্রধান জেমস জয়েসের 'ফিনেগানস ওয়েক' বইটির সন্ধানে দোকানে আসেন। বইটির একটিমাত্র কপি থাকায় সিলভিয়া সেটি বিক্রি করেন না। ক্রুদ্ধ জার্মান সেনা দোকানটি আর খুলতে দেন না।
১৯৫২ সালে ওয়াল্ট হ্যুইটম্যানের নাতি জর্জ হ্যুইটম্যান একটি বইয়ের দোকান খোলেন প্যারিসেই। তার নাম ছিল 'ল্য মিস্ত্রেল'। ১৯৬৪ সালে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্মের চারশো বছর উপলক্ষে দোকানটির নাম বদলে যায় 'শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি'তে। পাশাপাশি সিলভিয়া বিচকেও সম্মান জানানো হয় এভাবে। প্যারিসের নোতরদাম অঞ্চলে সেইন নদীর দক্ষিণে অবস্থিত এই দোকান। লেখকদের অফুরান প্রশ্রয়ে লালন করতে সর্বদা প্রস্তুত এই বুকশপ। দোকানের মধ্যেই থাকা ও খাওয়ার জায়গা। বিনামূল্যে সেখানে কোনো লেখক থেকে যেতেই পারেন। সারাদিন বই পড়া ও লেখালেখি করে দিন কাটাতে পারেন। শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানিতে যে বিতর্কসভা বা আলোচনা বা আড্ডা বসবে - তাতে যোগদান করতে পারেন৷ নিজের ভাবনাচিন্তা অবাধে প্রকাশ করতে পারেন সেখানে। আবার রসদও সংগ্রহ করে নিতে পারেন প্রয়োজনমতো। কফিশপের আলোচনাচক্রে থাকে নতুন কবিদের কবিতাপাঠ। কবি ও পাঠক, শ্রোতা - সবারই সেখানে সমান আতিথ্য।
বুকশপের মুখেই তাই লেখা থাকে,
Be not hospitable to Strangers
Lest They Be Angels in Disguise.
ভোর থেকে রাত বারোটা অবধি খোলা শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি। বই না কিনলেও দোকানে ঢুকে বই পড়া যায়। আর নচেৎ লেখা রয়েছে, Pay what you can, take what you need...
কিন্তু শর্ত একটাই পড়তে হবে। পড়াশোনা লেখালিখির আনন্দসাগরে ডুব দিতে হবে।
প্রশ্ন জাগে। কীভাবে এতদিন টিকে গেল এমন একটি বইয়ের দোকান? অন্তত এই বাজার-অর্থনীতির যুগে, যেখানে মুনাফাটাই বড়ো কথা। যেখানে লাভ ছাড়া কোনোকিছু নির্মাণের কথা ভাবাই হয় না। প্যারিস বলেই কি? বছরের পর বছর ধরে প্রথাভাঙার নানান লড়াইয়ের আঁতুড়ঘর বলে? প্যারী কমিউন বা তোলপাড়-করা ছাত্র আন্দোলনের চিন্তাস্রোতের ফল্গুধারারই কি নিদর্শন এই বুকশপ?
তবে যন্ত্রণা হয়। আমাদেরও বইপাড়া ছিল। ভাবনাচিন্তা মতামত প্রকাশের একটা অবকাশ ছিল। হালের আমফান সাইক্লোন সেই পাড়াকে ভাসিয়ে নিয়েছে। কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তাতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে ভাসা শারীরিক। আমাদের ভিতরে তার ভাবধারার প্রজ্জ্বলন থাকলে, সে পাড়া আবার জেগে উঠবে। কিন্তু মুশকিল হল, তার অনেক আগে থেকেই বইয়ের বাজার ক্রমশ মন্দায় ধুঁকছে । বইয়ের দোকান মানেই হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন কম্পিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতির বই। বইমেলার জন্যে প্রতিবারই স্থানাভাব হয়। খাদ্যমেলা ও বইমেলার মধ্যে পার্থক্য থাকে না। এমনকি স্বাধীন মতামত প্রকাশ করলে পুলিশ ও সরকারের রক্তচক্ষুও বইমেলায় জোটে। বর্তমানে কোনো দেশের অবস্থাই অবশ্য এরচেয়ে খুব ভালো নয়। তবু শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি নামে একটি দোকান টিকে যায়, আর অথৈ বৃষ্টিতে আমাদের গোটা পাড়াটাই ভেসে যায় - এ খানিক বেদনা দিয়ে যায় বৈকি।
Powered by Froala Editor