নন-স্ট্রাইকার এন্ড থেকে ইশারা সচিনের, কিউয়ি পেসারকে সামলালেন দ্রাবিড়

১.
অভিনেতা টম অল্টারের সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের কথা কে না জানেন আজ। সচিন তেন্ডুলকরের জীবনের সম্ভবত প্রথম ভিডিও ইন্টারভিউ। কতই বা বয়স তখন, পনেরো কিংবা ষোলো!

টমের প্রশ্ন ছিল, এত অল্প বয়সে ক্যারিবিয়ান সফরে তুমি যদি দলে চান্স পাও, তাহলে তা তোমার জন্য ভালো আদৌ হবে কি? কারণ আন্টিগুয়া, বার্বাডোজে তোমার সামনে থাকবে দুই বিশ্বত্রাস আম্ব্রোজ আর মার্শাল।

এর সম্ভাব্য উত্তরে বিশ্বের যেকোনো তরুণতম ক্রিকেটারের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যেতে বাধ্য। অথচ সেই ঢলঢলে শার্ট আর ঝাঁকড়া চুলের বাচ্চাটা উত্তরে জানাল-
"It will not create a problem for me, I like to play fast bowlers as the ball comes straight on the bat…"

এই আত্মপ্রত্যয় যখন একটা ষোলো বছরের ছেলে দেখাচ্ছে, তখন তাঁর কাছে গতিময় বোলার খেলার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে একটাই নাম- রাজু কুলকার্নি!

সচিনের অভিজ্ঞতা আর আম্ব্রোজ-মার্শালের হিংস্রতার মাঝখানে তফাৎ ছিল এক গগনচুম্বী আত্মপ্রত্যয়ের। তিনি অধ্যাবসায়ের বলে বলীয়ান হয়ে শান্ত, তিনি জানেন তাঁর ক্ষমতার স্ফূরণ, ঐ বয়সেও তাই তিনি শান্ত। এখানেই সচিন অনন্য!

যাঁরা সচিন বলতে শুধু ক্রিকেট বুঝলেন, তাঁরা সচিনের বুঝলেনটা কী?

২.
অনেক বছর পর৷ কোনো এক মোহালির সকাল। ভারতের সামনে একমাত্র লক্ষ্য জয়। ক্রিজে ক্রিকেট ঈশ্বর ও রাহুল দ্রাবিড়। সেদিনের ঝাঁকড়া চুলের তরুণ এখন বিশ্বক্রিকেটের সুপারস্টার। সে সময়ে রিভার্স সুইং ছিল খুব জনপ্রিয়। এখন বল চেঞ্জ দ্রুত হয় বলে পুরোনো সিমে রিভার্স সুইং-এর মজা নেই তেমন। তখন পুরোনো বলের অসমান মসৃণতাকে কাজে লাগিয়ে রিভার্স সুইং করে তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যানকে বিপদে ফেলতেন বোলাররা। কিউয়ি পেসার ক্রিস কেইর্নস নিজের দ্বিতীয় স্পেলে বল করছেন। পুরোনো বলে পরপর রিভার্স সুইং। সচিন কিছুতেই ধরতে পারছেন না বলের বাঁক। দু-তিনবার একটুর জন্য উইকেট পড়া থেকে বাঁচলেন। নন স্ট্রাইকারে দ্রাবিড় দাঁড়িয়ে করুণ মুখে। ভারতের শেষ ব্যাটিং পেয়ার। উইকেট পড়লে চাপ বাড়বে৷ এদিকে কিউইদের ফিল্ডিং আগ্রাসী হয়ে উঠছে ক্রমশ। সচিন রাহুলকে ডাকলেন। বললেন-

"আমি তোমাকে একটা ট্রিক বলতে চাই রাহুল।"
"এই ওভারে তিন বল বাকি, তিন বল শেষে কি আর বলার প্রয়োজন থাকবে?"
"থাকবে। আমি তিনটে বল সামলে নিচ্ছি। কিন্তু পরের ওভারে তুমি আর সমস্যায় পড়বে না এই ট্রিক খাটালে।"

কেইর্নসের পরের ওভারে সামনে দ্রাবিড়। প্রথম দুটো বল আউট সুইং কাটল, দুটোতেই ড্রাইভ করলেন রাহুল। পরের দুটো ভেতরে ঢুকল এবং সাবলীল ভাবে লেগে শাফল করে দিলেন দ্যা ওয়াল। ক্রিস অবাক। অবাক মোহালির দর্শকরা। যে কেইর্নসের রহস্য স্বয়ং সচিন ধরতে পারলেন না, তা কেমন করে ধরলেন রাহুল?


এর উত্তর ম্যাচ শেষে দিয়েছিলেন সচিন। ওভারের শেষে দ্রাবিড়কে তিনি বলেন-
"ব্যাটসম্যানের পক্ষে কেইর্নসের বলের দিক বোঝা সম্ভব না। একমাত্র বলের পালিশ ও কোনদিকে রাখছে তা দেখতে পেলেই সহজে বুঝে নেওয়া যাবে বল ইন না আউট সুইং খাবে। এই কাজ ব্যাটসম্যান পারবে না, পারবে নন-স্ট্রাইকার। আমি ওর হাত দেখতে পাব যখন ও রান আপ নিতে যাবে। যদি ইনসুইং হবে বুঝি তবে আমার ব্যাট আমি বাঁ হাতে ধরে থাকব, যদি আউট সুইং হয় তবে ডান হাতে।"

সচিনের এই নির্দেশে দ্রাবিড় অনায়াসে পাঁচটা বল খেলে দেন। কিন্তু শেষ বলে ধূর্ত কেইর্নস ধরে ফেললেন ট্রিকটা। তিনি ক্রস সিমে বল নিয়ে দৌড়ালেন। সচিন ব্যাটটাকে সিন গার্ডে হেলান দিয়ে ঈশারা করে দিলেন। ক্রিকেটের বরপুত্র দ্রাবিড়ের কাছে এই ইঙ্গিত বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি। তাই ষষ্ঠ বলেও এল বাউন্ডারি…

ক্রিকেট বদলে গেছে, এসে গেছে প্রযুক্তি,এসেছে নিয়মের বেড়াজাল শুধু ইতিহাসের পাতায় চলে যাওয়া ক্রিকেটের ঈশ্বর আর ফিরে আসেননি। সচিন তেন্ডুলকর প্রসঙ্গে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট বিশ্লেষক সংস্থা লিখেছিল- "A revolution of Indian cricket whose genius changed the future of an entire nation" - সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে হয়তো অনেকেই সচিন নামক এভারেস্ট ডিঙিয়ে যাবেন। কিন্তু একটু একটু করে ভারতের এভারেস্ট হবার জন্য শুধু ক্রিকেট নয়, সচিনের গগনচুম্বী প্রতিভার পাশে জমেছিল ঐশ্বরিক বোধ। সচিন এভারেস্ট ডিঙোননি, তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক এভারেস্ট। এখানেই তিনি ঈশ্বর৷ পৃথিবীর সমস্ত অগ্নিকুণ্ডের আগুন পেরিয়ে এসেছিল তাঁর অবিনশ্বর এমআরএফ ব্যাটটা। ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে যেত সপাটে স্ট্রেট ড্রাইভগুলো।

সচিনকে সচিন হয়ে উঠতে করতে হয়েছে অসাধ্যসাধন। অনেকে বলেন, সচিন তো ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভা। একথা যেমন ঠিক, তেমনই প্রতিভার কুসুমকে আগলে রাখার কঠিন বর্মও কিন্তু সচিনকেই বানিয়ে নিতে হয়েছিল তাঁর পাঁজরের অস্থি দিয়ে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নেট প্র্যাাকটিসে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন সচিন, প্রতিভার প্রস্তরখণ্ডকে একটু একটু করে খোদাই করে তিনি দেবতার জন্ম দিয়েছেন - সচিনের সচিন হয়ে ওঠার রহস্য এখানেই লুকিয়ে।

ঈশ্বরের মন্দিরে লেখা হয় ভারতের জয়গাথা, কত খেলোয়াড় আসবেন, কতজন চলে যাবেন, রেকর্ডবুক পাল্টে যাবে আবার। শুধু একটা 'সচিন! সচিন…' ওয়েভ আসমুদ্র হিমাচল ভারতের শেষ চিৎকার হয়ে থেকে যাবে আজীবন…

Powered by Froala Editor