অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ঝাড়ুদার থেকে ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়’ – রাসবিহারীতে নাস্তানাবুদ পুলিশ

১৯১২ সালের ডিসেম্বর মাস। অশান্ত, বিপ্লবীদের আখড়া কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশরা। হাতির পিঠে চেপে সস্ত্রীক দিল্লির রাজপথে হাজির হয়েছেন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ। হাজির হয়েছে একটি মেয়ে, লীলাবতীও। অন্যান্যদের মতো বড়লাটকে দেখার তার বড়ই সাধ। কিছুক্ষণ পর ‘শান্ত’ দিল্লিই কেঁপে উঠল বোমার ভয়ংকর আওয়াজে। গুরুতর আহত হলেন হার্ডিঞ্জ। মারা গেল মাহুত। তার মধ্যেই ভাগলওয়া মেয়েটি। পরে জানা যায়, সভায় থাকা সেই মেয়েটিই ছদ্মবেশে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস।

সে না হয় হল, কিন্তু এই হামলার মাস্টারমাইন্ড কে? খোঁজ পড়ে গেল চারিদিকে। এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনার পরেই এর প্রতিবাদে দেরাদুনে আয়োজিত হল একটি সভা। সেই সভায় বড়লাটের ওপর হওয়া এই হামলার নিন্দা করলেন এক বাঙালি যুবক। পুলিশের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন তিনি। বিপ্লবীদের ওপর তাঁর প্রচণ্ড ‘রাগ’ বেরিয়ে এল বক্তৃতার মঞ্চে। সাহেবরা অভিভূত। পরবর্তীকালে, বসন্ত বিশ্বাসরা ধরা পড়ার পর, দিল্লির ঘটনার মাস্টারমাইন্ডের পরিচয় সামনে এল। আর তা জেনে হতবাক ব্রিটিশ অফিসাররা। এ কি শুনছেন তাঁরা! যে বাঙালি যুবক দেরাদুনে এত বিক্ষোভ দেখাল, সে-ই কিনা মূল ষড়যন্ত্রকারী? আড়ালে তখন মুচকি হাসছেন সেই যুবক, রাসবিহারী বসু। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।

এই ঘটনার পর রাসবিহারী বসু’র ভারত পর্ব খুব বেশিদিনের ছিল না। ১৯১৫ সালে খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। তবে তার আগে পর্যন্ত, ব্রিটিশদের সঙ্গে তাঁর ছিল চোর-পুলিশের সম্পর্ক। বহুবার, নানা ভাবে চেষ্টা করা হয়েছে তাঁকে ধরার। যতবারই চেষ্টা করা হয়েছে, ততবারই চোখের সামনে দিয়ে পালিয়েছেন রাসবিহারী। তাঁর গল্প কেবল একজন বিপ্লবী এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নয়। সেই সঙ্গে একজন তুখোড় ছদ্মবেশী ও অভিনেতারও গল্প বটে!

১৯১২-এর দিল্লির ঘটনার রিপোর্ট সামনে আসার পর রাসবিহারীকে নিয়ে সাহেব মহলে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মারাত্মক। অনেকে তো বিশ্বাসও করতে চাননি। এত প্রভুভক্ত একজন কি করে এটা ঘটাতে পারে? আসলে তখন থেকেই যে তিনি আন্দোলনের পরিকল্পনা নিতে শুরু করে দিয়েছেন, সে কথা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেননি। তবে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ধরার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল ব্রিটিশ রাজ। সাড়ে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত মাথার দাম ঠিক করা হল। কিন্তু কোথায় কি? যত চেষ্টা করতে লাগলেন, ততই তাঁদের সামনে দিয়ে পালিয়ে যেতে লাগলেন রাসবিহারী বসু। কখনও চাকরের ছদ্মবেশ, কখনও মালি, কখনও দেহাতি লোক— নানা রূপে গোটা ভারতে ঘুরতে লাগলেন তিনি।

একবার শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা— এই পুরো এলাকা পুলিশ ঘিরে রাখল। পাকা খবর আছে, রাসবিহারী বসু এখানেই আছেন। সমস্ত জায়গায় খানা তল্লাশি শুরু হল। কিন্তু কোথায় কি! কেউ নেই! পাগলের মতো অবস্থা পুলিশের। কিন্তু খবর তো সত্যিই পাকা ছিল। তাহলে? শিয়ালদহ পোস্ট অফিসে বসে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান একমনে বেহালা বাজিয়ে চলেছেন। কিছু না পেয়ে, ফিরে গেল পুলিশ। এদিকে সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ানটির, থুড়ি রাসবিহারীর মুখেও দেখা দিল কিঞ্চিৎ হাসির রেখা। এমন অভিনয় করলেন তিনি, কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারল না।

বেশ কয়েকবার তো ব্রিটিশদের সামনে দিয়ে তাদের জানিয়ে পালিয়ে গেছেন তিনি! একবার খবর এল, বেনারসে লুকিয়ে আছেন রাসবিহারী বসু। যে বাড়িতে লুকিয়েছিলেন, সেই বাড়ি ঘিরে ফেলল সশস্ত্র পুলিশ। দরজায় ধাক্কা দিতেই, এক বৃদ্ধ উড়ে ঠাকুর বেরিয়ে এল। রাসবিহারীর ছবি দেখাতেই সে দেখিয়ে দিল ওপরের ঘর। আর পায় কোথায়! সমস্ত পুলিশ ছুটে চলে গেল ওপরে। কিন্তু ঘর তো ফাঁকা! এদিকে সেই উড়ে ঠাকুরটিও কোথায় পালিয়ে গেছে কে জানে। হঠাৎ টনক নড়ল ব্রিটিশ পুলিশের। তাহলে কি ওই ঠাকুরই কি রাসবিহারী? যতক্ষণে বুঝতে পারলেন, ততক্ষণে তো রাসবিহারী বসু চলে গেছেন অনেক দূরে।

পরের একদিনের ঘটনা। চন্দননগরে এসেছেন তিনি। গোপন সূত্রে খবরও পেয়ে গেল ব্রিটিশ পুলিশ। গোটা বাড়ি ঘিরে নেওয়া হল। এমন ব্যবস্থা করা হল, যাতে মাছিটিও গলতে না পারে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ কেটে গেল, তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল না। এবারও বিফল হল। খবর এল, ফাঁক পেয়ে পাখি পালিয়েছে। কিন্তু কখন? পুলিশের খেয়াল পড়ল, একটি ঝাড়ুদারই শুধু বাড়ি পরিষ্কার করে, বালতি আর ঝাঁটা হাতে বেরিয়ে গেছিল। বোঝা গেল, সেই ময়লা গায়ের ঝাড়ুদারই তাঁদের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ বিপ্লবী, রাসবিহারী বসু…

এমনকি, ভারত ছেড়ে যখন জাপান যান, তখনও ছদ্মবেশেরই আশ্রয় করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় ‘রাজা প্রিয়নাথ ঠাকুর’ নামে জাহাজে চাপেন তিনি। এমনকি, এই নামে নিজে গিয়ে পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্টও সংগ্রহ করেন। বাকি ইতিহাস তো সবারই জানা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীরপুরুষ ছিলেন তিনি। শুরুর দিন থেকে বারবার ব্রিটিশদের ধোঁকা দিয়ে এসেছেন, নাস্তানাবুদ করেছেন। এই সবই, স্বাধীনতার জন্য।

Powered by Froala Editor