মৃত্যুশয্যায় পেয়েছেন বিশ্বকবির স্পর্শ, বহু কর্মধারায় বিস্তৃত ছিল রামেন্দ্রসুন্দরের জীবন

১৯০৭ সাল। বঙ্গভঙ্গের ঘা তখনও জ্বলছে বাঙালির বুকে। চলছে প্রতিবাদের প্রস্তুতি। বঙ্গভূমির পুণ্যশরীর থেকে বিভেদের কালিমা মোছাতে হবে। ভাষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানচর্চার মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে স্বাজাত্যবোধ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের তৎকালীন সম্পাদক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর (Ramendra Sundar Tribedi) নেতৃত্বে শুরু হল ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন’। কার্যকরী সভাপতি পদে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রামেন্দ্রসুন্দর-রবীন্দ্রনাথ যুগলবন্দি ভাঙা বাংলায় জাগিয়ে তুলল আশা। বাঙালির জীবনচর্যায় শুরু হল নতুন দিনের পদযাত্রা।

বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তে তীব্র আঘাত পেয়েছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। বুঝেছিলেন বঙ্গবিভাজন শুধু রাজনৈতিক সীমারেখা নয়, বাঙালির জীবনের অন্তরাল সংস্কৃতির গোড়া ধরে টান মারবে। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে সমস্ত পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে পড়েন। সেই চিন্তা থেকেই শুরু হয় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন’। লেখেন ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’। যার একটা ছড়া ছিল,

“ভাই ভাই এক ঠাঁই
ভেদ নাই ভেদ নাই।”

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জন্ম ১৮৬৪ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার জেমো কান্দি গ্রামে। ছিলেন বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র। পদার্থ বিদ্যায় স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা শেষ করে বিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে) অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। সেই সূত্রেই বুঝতে পারেন বাংলাসাহিত্যে বিজ্ঞানচর্চার উপযুক্ত পরিকাঠানো নেই। সমস্যা বহুবিধ। বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব ও গবেষণাচর্চাগুলিকে বাংলা ভাষার নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না। অনুবাদের সহজবোধ্য পদ্ধতি নেই। আছে পরিভাষার সমস্যা। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ইংরেজপ্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যম। 

আরও পড়ুন
কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাণপুরুষ তিনি, বিস্মৃতির অতলে ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস

এর আগেই ১৮৯৩ সালে শোভাবাজারের রাজা বিনয়কৃষ্ণের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘বেঙ্গল একাডেমি অফ লিটারেচর’। উদ্দেশ্য বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি। সংগঠনের নামেই স্পষ্ট যে বাংলাভাষার উন্নতিকল্পে হলেও কার্যক্রম চলত ইংরেজি ভাষায়। স্বাভাবিকভাবেই শুরু হল মতবিরোধ। কিছুদিনের মধ্যে সংগঠনটিকে নতুন করে গড়ে তুলে নাম রাখা হয় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’। ১৮৯৪ সালে সম্পাদক হন রামেন্দ্রসুন্দর। ইতোমধ্যে পরিষদের পক্ষ থেকে পরিভাষা রূপায়ণের জন্য আট সদস্যের একটি শাখাসমিতি গঠন করা হয়। রামেন্দ্রসুন্দরের ‘বৈজ্ঞানিক পরিভাষা’, ‘রাসায়নিক পরিভাষা’ ইত্যাদি গ্রন্থের সুবাদে পরিষদের কর্মকাণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে ওঠে। 

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একই বছরে জন্ম, বিস্মৃতির অতলে ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

এদিকে সমানতালে চলছে বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা। তৈরি করে চলেছেন একের পর এক পরিভাষা। যেমন- লেন্স অর্থে পরকলা। কিংবা প্রিজম অর্থে কলম। তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী দক্ষতা, সাবলীল বৈজ্ঞানিক বক্তব্য ও মৌলিক পরিভাষায় সাবালক হওয়ার পথে এগিয়ে দিলেন বাংলাভাষার প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চাকে। বিজ্ঞানের দুরূহ দর্শনকে আর দূরদেশীয় মনে হল না। 

‘জিজ্ঞাসা’, ‘বিচিত্র জগৎ’, ‘জগৎকথা’ ইত্যাদি গ্রন্থ জুড়ে ছড়িয়ে রইল তাঁর বিজ্ঞানচেতনা। গ্রন্থগুলির আলোচনার পরিধি দেখলে অবাক হতে হয়। বিবর্তনবাদের পরিধি ছুঁয়ে, অণু-পরমাণুর গবেষণাকে ব্যাখ্যা করে মহাকাশচর্চার দূর আলোকবর্ষে পাড়ি দিল বিজ্ঞানপ্রতিভা। এ বিষয়ে ‘ফলিত জ্যোতিষ’ প্রবন্ধটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করার লোভ সামলানো যায় না। প্রবন্ধটিতে জ্যোতিষচর্চা ও জ্যোতিষীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে তীব্রভাষায় আক্রমণ করেছেন তিনি। একটু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক,

“তাঁহারা তর্ক করিতে বসিবেন, রামচন্দ্র খাঁয়ের পুত্রের জন্মকালে বুধগ্রহ যখন কর্কটরাশিতে প্রবেশ করিয়াছে, তখন সেই পুত্র ভাবীকালে ফিলিপাইনপুঞ্জের রাজা হইবেন, তাহাতে বিস্ময়ের কথা কী?”

মানুষটির ধ্যানজ্ঞান আশ্রয় করেছিল ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’। স্ত্রী ইন্দুপ্রভা দেবীর সংসারের প্রায় সবটা জুড়েই ছিল সাহিত্য পরিষদ। শুধু বিজ্ঞানচর্চা নয়, বাংলাভাষাচর্চার সার্বিক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নানাভাবে মুখর করে তুলেছিল তাঁকে। সেই উদ্দেশ্যেই বঙ্গভঙ্গের উত্তাল সময়ে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে যান। প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল কাশিমবাজারের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর উদ্যোগে। পরবর্তীতে কলকাতা তো বটেই; বরিশাল থেকে ভাগলপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সাহিত্য সম্মেলনের গতিবিধি। 

মানুষ চিনতে রবীন্দ্রনাথ ভুল করেননি। তাই হয়তো রামেন্দ্রসুন্দরের শেষশয্যা পর্যন্ত সঙ্গদান করে গেছেন। ১৯১৯ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মারা যান রামেন্দ্রসুন্দর। সে বছরই জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রোগশয্যায় শুয়েই রামেন্দ্রসুন্দর জানতে পারলেন সেই খবর। শরীর দুর্বল, মৃত্যু আসন্ন; রবীন্দ্রনাথ কি একবার শেষ দেখা দেবেন না? রামেন্দ্রসুন্দরের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ পড়ে শোনালেন বড়লাটকে লেখা নাইট উপাধি ত্যাগের পত্র। মুহূর্তে যেন জ্বলে উঠল রামেন্দ্রসুন্দরের চোখ, গভীর পরিতৃপ্তির ছায়া দেখা দিল মুখে। রবীন্দ্রনাথের পদধূলিতে শেষবার স্পর্শ পেলেন অভিন্নহৃদয় কর্মসঙ্গীর। বহু যজ্ঞের আগুন নির্বাপিত হতে চলেছে। কিছুদিন পরেই তাঁর শেষ দৃষ্টি বিজ্ঞানের নাগাল পেরিয়ে পাড়ি দিল কোনো এক অজানা জ্যোতিষ্কলোকের উদ্দেশ্যে।

বাঙালির শিক্ষা-সংস্কৃতির কিংবা বিজ্ঞানচর্চার বুনিয়াদের গভীরে ছড়িয়ে আছে রামেন্দসুন্দরের সাধনাপূর্ণ জীবন। বাংলাকে চিনতে গেলে একবার ছাই ঘেঁটে দেখে নেওয়া উচিত তাঁর জীবনচরিতকেও।

তথ্যঋণ—
১. ঘরে-বাইরে রামেন্দ্রসুন্দর, শ্রীবীরেন্দ্রনারায়ণ রায়
২. রামেন্দ্রসুন্দর জীবন-কথা, শ্রীআশুতোষ বাজপেয়ী
৩. পথিকৃৎ রামেন্দ্রসুন্দর, ডঃ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
৪. জিজ্ঞাসা, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More