সিগারেটের কারখানা উদ্বোধন করবেন রবীন্দ্রনাথ, বানানো হল ফুলের তোরণ

আজকাল প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের দিকে নজর ঘুরছে দেখছি। আগে ছিল না, তা নয়। তবে ইদানিং যেন একটু বেশিই দরকার পড়ছে । কারণটা অনুমেয়। চারপাশের ধাক্কায় সবাই গিয়ে পড়ছে ওই বুড়ো লোকটার ঘাড়ে। তবে এই যে পাতিপাতি করে রবীন্দ্রনাথ কোথায় কী বলেছিলেন সেটা খোঁজার চেষ্টা, তাতে তো শুধু সেটুকু চোখে পড়ে না। তার বাইরের মশলাপাতিগুলোও নজর কাড়ে। এই যেমন, কাউকেই 'না' বলতে পারতেন না রবীন্দ্রনাথ। কোনো কাজেই 'না' ব্যাপারটা নেই৷ কেউ কোথাও যেতে বলল, তো কেউ কিছুর নামকরণ করতে বলল, কেউ কিছু লিখে দিতে বলল - তো সান্তাক্লসের মতো সেসব দাবিদাওয়া মিটিয়ে চলেছেন।

তেমনি খবরাখবর পেয়ে এক সিগারেট কারখানার মালিক এসে হাজির রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ তখন বোম্বাইতে। কারখানার মালিক কী ভেবেছিলেন কে জানে? ভেবেছিলেন হয়তো এটাও একপ্রকার স্বদেশি উদ্যোগ। সিগারেট তো কী হয়েছে। তাই তার উদ্বোধনে কবিকে নিমন্ত্রণ জানানোই যায়। যায় যে, তা প্রমাণ করলেন স্বয়ং বিশ্বকবিই। কথা দিলেন, 'হ্যাঁ, নিশ্চিত যাবেন তিনি।'

তবে এরকম নানা জায়গায় যাওয়ার কথা বহুজনকে দিতেন। দেওয়ার সময় খেয়াল থাকত না। পরে দেখা যেত, ওই একইদিনে একই সময়ে আরো তিন জায়গায় যেতে হবে তাঁকে। স্বাভবিকভাবেই একটি কথা রেখে, বাকিগুলোকে খসিয়ে দিতে হত। সিগারেট-কারখানায় যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধ সাধলেন সরোজিনী নাইডু। কিছুতেই সেখানে তিনি কবিকে যেতে দেবেন না। নির্দিষ্ট দিনে কারখানার মালিক এসে উপস্থিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যাচ্ছেন না। অথচ কারখানায় দেদার আয়োজন, ভিড়। রবীন্দ্রনাথ তখন ঠেলেঠুলে সেখানে পাঠালেন রানী চন্দকে। শুধু নির্দেশ দিলেন গম্ভীর থাকতে। হেসে যেন না ফেলেন।

কারখানার বিশাল আয়োজন দেখে বাস্তবিকই চোখ ছানাবড়া রানী চন্দের। ফুলের তোরণ পার করে তাঁকে বসানো হয় এক রাজসিংহাসনে। আর তারপর গান গাওয়া হয়, ' জয় জয় রবীন্দ্র কবীন্দ্র জয়তু…'।

রানী চন্দ তখন পারলে মাটিতে মেশেন।

তা রবীন্দ্রনাথের এই খামখেয়ালি আচরণের জন্য অনেককেই অনেকবার বিপাকে পড়তে হয়েছে। যেমন একবার প্রচণ্ড গরমে শান্তিনিকেতন ছেড়ে, কালিম্পঙে যাবেন ঠিক হয়েছে। শরীরস্বাস্থ্য উদ্ধারের চেষ্টায়। যাওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সারা। এমনকি ট্রেনে সমস্ত মালপত্র উঠে গেছে। শুধু গুরুদেবের ওঠা বাকি। হঠাৎ বোলপুরের আকাশে একখণ্ড কালো মেঘ দেখলেন, অমনি সবাইকে ফেলে রেখে চলে এলেন উদয়নে। অথবা কোথাও গিয়েছেন, সবাই দিনের হিসেব করে, জামাকাপড় গুছিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে তাঁর ঠিক সেই জোব্বাটারই খোঁজ পড়ত, যেটা আনা হয়নি। বা যে ক্ষুদ্রাকার পেন্সিলটিকে ফেলে আসা হয়েছে টেবিলে, সেটারই দরকার পড়ত ছবি আঁকার সময়। সেটাতেই নাকি সবথেকে ভালো আঁকা হয়।

হ্যাঁ, নাকানিচোবানি এতে কিছু লোক খেয়েছে বটে। তাদের কাছে সাফাইও গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, ' জানিস না, আমি দ্বারকানাথের নাতি…'। প্রিন্স দ্বারকানাথের নামে এটা প্রচলিত ছিল-'… Babu changes his mind so often…'। সেই ট্রাডিশনই নাকি বয়ে চলছেন রবীন্দ্রনাথ। সত্যিই কী অকাট্য যুক্তি। বংশের ধারা কি বদলানো যায়?

লোকের আর রাগ করার উপায় থাকে না।

[ঋণঃ 'গুরুদেব', রানী চন্দ]