১৯২৮ সাল। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিকিৎসা করাতে সস্ত্রীক লন্ডন গেছেন। এবার রবীন্দ্রনাথের যাওয়ার পালা। কবির সাথে বিলেতে যাবেন দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ ও শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের অধ্যক্ষ আরিয়াম উইলিয়াম। আরিয়াম সিংহলের মানুষ। বাড়ি জাফনায়। বিলেতের জাহাজে কবি উঠবেন মাদ্রাজ থেকে। প্রেসিডেন্সিতে তখন গরমের ছুটি। কবির অনুরোধে অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও তাঁর স্ত্রী নির্মল কুমারী ওরফে রানী মহলানবিশও তাঁদের সঙ্গী হলেন। মাদ্রাজে তখন প্রচণ্ড গরম আর রবীন্দ্রনাথেরও বয়সজনিত কারণে শরীর বেশ অসুস্থ। মাদ্রাজে কিছুদিন অ্যানি বেসান্তের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তাঁরা। এরপর পিঠাপুরমের মহারাজা কবিকে কুনুর শৈলাবাসে আমন্ত্রণ জানালে সকলে মিলে কুনুর চলে গেলেন।
পাহাড়ি ঠান্ডায় রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছুটা সুস্থ হলেও অন্য একটি ব্যাপারে বেশ নাজেহাল হয়েছিলেন। তা হল, খাওয়াদাওয়া। এই ব্যাপারটিতে এমনিতে খুব নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। ভোর চারটেয় উঠে চা খাওয়া তাঁর সারাজীবনের অভ্যাস। কখনও হয়ত দূরপাল্লার ট্রেনে যাত্রা করছেন, তখনও তাঁর চাকর বনমালী রাত আড়াইটেয় উঠে চায়ের জল চাপিয়ে দিত। আর খেতেনও খুব অল্প। কিন্তু কুনুরে রাজা-মহারাজাদের ব্যাপার। তাঁরা দশটার আগে বিছানা ছাড়েন না, তাঁদের দিনই শুরু হয় দুপুর বারোটা থেকে। তার উপর অত বেলা করে দিন শুরু হওয়ার দরুন প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ একসাথে মিলিয়ে এলাহি খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হত। প্রাতরাশে বিলিতি খানা আর মধ্যাহ্নভোজে দেশীয় রান্না। আর সেই অন্ধ্রদেশীয় রান্নায় মারাত্মক ঝাল। সবদিক দিয়েই হয়ছে মুশকিল। মহারাজ নিজে বসিয়ে খাওয়াতেন। তাই তাঁর সামনে বসে খাবার রেখে উঠেও যাওয়া যেত না। কোনো কোনো দিন অ্যান্ড্রুজ রাজাকে কথায় ভুলিয়ে রাখতেন আর সেই ফাঁকে রবীন্দ্রনাথ অল্প খেয়ে খাওয়া শেষ করতেন। কিন্তু তা তো আর রোজ করা যায় না। এরকম বাড়াবাড়ি রকমের আতিথেয়তায় রবীন্দ্রনাথ রীতিমত যন্ত্রণায় পড়েছিলেন।
এই যন্ত্রণার থেকে পরিত্রাণ পেতে নির্মল কুমারী একদিন রাতে চুপিচুপি চাকরবাকরদের বললেন ভোরের জন্য ফ্লাস্কে একটু চা, একটু দুধ আর রুটি-মাখন রেখে দিয়ে যেতে। রাজরাজড়ার ব্যাপার। বলা হয়েছে একটুখানি দিতে, তারা তিনটে ফ্লাস্কে দুধ, গরম জল, কফি, চা, সঙ্গে অঢেল পরিমাণে পাউরুটি, জ্যাম, জেলি, মাখন এনে হাজির করেছে। তিনজনের তো চক্ষু চড়কগাছ। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে খুব অসুস্থ তখন, তার মধ্যেও ঠাট্টার মেজাজ তাঁর অটুট। প্রশান্ত-রানী তাঁকে শান্তিনিকেতনে দেখতে এসেছেন, তাঁদেরকে এই খাওয়া নিয়ে ঠাট্টা করে বলেছিলেন – ‘আরো কিছুদিন অনায়াসে থাকতে পারা যেত। তা না, খাইয়ে তাড়িয়ে দিলে গো। একেই বলে রাজকীয় বদান্যতা।’
তখন গরমকাল। আর গরম মানেই আমের মরশুম। কুনুরে রাজার নিজস্ব বাগান থেকে পার্সেলে করে আম আসত। বিকালবেলা চায়ের সাথে আমের সরবতও পরিবেশন করা হত। প্রথমদিনেই সেই সরবত খেয়ে রীতিমতো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা অবশ্য রবীন্দ্রনাথের নয়, প্রশান্তচন্দ্রের। রবীন্দ্রনাথ আর রানী যে দুটো গ্লাসে সরবত খেয়েছেন, তাতে কিছু অসুবিধা হয়নি। প্রশান্ত যেই নিজের গ্লাসের সরবতটুকু মুখে দিয়েছেন, অমনি তাঁর চোখ জলে ভরে উঠেছে। না না, আম খেতে গিয়ে আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়েননি। আমের সরবতে মেশানো ছিল লঙ্কার গুঁড়ো। তার উপর তিনি একেবারেই ঝাল খেতে পারতেন না। প্রশান্তর ওই অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথ আর ফলের রস ছুঁয়ে দেখারও ঝুঁকি নেননি। প্রশান্তকে বলেছিলেন –‘ওহে প্রশান্ত, অন্ধ্রদেশীয় আমের রসকেও বিশ্বাস নেই।’ সেজন্যে ভোরেই তিনি ফলাহার সেরে নিতেন। রবীন্দ্রনাথ কীভাবে আম খেতেন, তা যে কেউ শুনলে অবাক হবে। আমটাকে টিপে টিপে তলতলে নরম করে দেওয়া হত, তারপর রবীন্দ্রনাথ একেবারে ছেলেমানুষের মতো দুহাতে আম ধরে চুষে চুষে খেতেন। আর আম খাওয়ার সময় রোজ বলতেন – ‘ভদ্রভাবে আম খাবারও উপায় নেই? তিনজনে তিন শিশুর মতো আম মুখে দিয়ে চুষতে লেগেছি আর দাড়ি বেয়ে রস পড়ছে। আহা, কী দৃশ্য!’