সত্তরের দশক বাংলায় রক্তের দশক। একদিকে যেমন মানুষজন দেখেছে নকশাল আন্দোলন, অন্যদিকে আরও একটি ঘটনা ভারতের ইতিহাসে চিরকালের মতো প্রভাব রেখে যায়। এমারজেন্সি, বা জরুরি অবস্থা। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে এই ১৮ মাস-ব্যাপী সময়ে বহু সংবাদপত্র, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠরোধ করা হয়। অনেকে জেলও খাটেন। বাংলাও তার ব্যাতিক্রম ছিল না। ব্যাতিক্রম ঘটেনি কবি শঙ্খ ঘোষের ক্ষেত্রেও। পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি যিনি, তাঁকেও জরুরি অবস্থায় নিষেধের কোপে পড়তে হয়েছিল। অবস্থা এখনও বদলেছে কি?…
‘দেশ’ শারদীয়া সংখ্যা ছাপানোর কাজ চলছে তখন। হঠাৎ শঙ্খ ঘোষ শুনতে পেলেন, তাঁর কবিতা নাকি এবার ‘দেশ’-এ প্রকাশ পাবে না। কেন? না, সরকারের নিষেধাজ্ঞা। আকাশ থেকে পড়লেন তিনি। তা কেমন করে হয়? এই তো সম্পাদক সাগরময় ঘোষ নিজে চাইলেন কবিতা। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন তাঁকে। কথাটা যে স্রেফ গুজব নয়, সেটাই জানালেন সাগরময় ঘোষ। রাইটার্স থেকে না ছাপানোর নির্দেশ এসেছে। বিরোধী কোনো কথাই যে তখন বলা যাবে না! সাগরময় ঘোষ সসংকোচে অন্য লেখা দিতে বললেন। এতে যেকোনো লেখক, কবির রাগ হতে পারে। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ শান্ত থাকলেন। সেইভাবেই বললেন, “অন্য কোনো কবিতা তো পারব না পাঠাতে। কেননা যা-কিছু লিখছি এখন, তার সবটাই তো ও-রকম সরকারি হুকুম নিয়ে ফিরে আসতে পারে”। সেবার আর দেননি লেখা।
জরুরি অবস্থার কোপ এতেও থামেনি। ছোট পত্রিকাগুলো লেখা চাইতে এলে শঙ্খ ঘোষ প্রথমেই বলে দেন তাঁর শর্ত। ছাপতে হলে এইভাবে, কোনোরকম বদল না করে এই লেখাই ছাপাতে হবে; ঝুঁকি নিয়ে হলেও। অনেকেই সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে পিছিয়ে যান। একই কথা বললেন ‘লা পয়েজি’-র সম্পাদক বার্ণিক রায় ও ‘সাহিত্যপত্র’-র সম্পাদক অরুণ সেন। কিন্তু তাঁরা পিছিয়ে আসেননি। সেই বছরই, অচলাবস্থার মধ্যেও ছাপা হয় শঙ্খ ঘোষের ‘রাধাচূড়া’ ও ‘আপাত শান্তিকল্যাণ’ কবিতা দুটি। না, লেখক-সম্পাদক, কাউকেই হাজতবাস করতে হয়নি।
তবে শুধু লেখার জগতেই নয়, আকাশবাণীর মতো প্রতিষ্ঠানও সেই কোপ থেকে রেহাই পায়নি। স্বয়ং শঙ্খ ঘোষও কিছু কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। দূরদর্শনের শুরুর সময় তখন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন এবং অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে সেখানে হবে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন’ শীর্ষক এই রেকর্ডিংয়ে অবনীন্দ্রনাথের যাত্রাপালার একটি অংশ পড়া হচ্ছিল। হঠাৎই অনুষ্ঠানটির প্রযোজক শঙ্খ ঘোষকে একটি লাইন বদলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। স্টেশন ডিরেক্টর নাকি আপত্তি জানাচ্ছেন এটা রাখতে। লাইনটি ছিল- “তখন ইন্দ্রের ভয়ে ঘরে কুলুপ দিয়েছেন ব্রহ্মা”। দর্শকদের কানে ‘ইন্দ্র’ যদি ‘ইন্দিরা’ হয়ে যায়! তাহলে তো আবার কারাবাস! জরুরি অবস্থার সময় এমন ঘটনাও প্রতিনিয়ত ঘটেছে।
সাধারণ লোকজন তো বটেই, শিল্প সাহিত্য জগতেও যে একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল, সেটা স্বীকার করেন শঙ্খ ঘোষ। শুধু তিনি কেন, অনেকেই সেটা করবে। একটা কবিতা বা গল্পের লাইন, একটা শব্দও তখন আতস কাচের নীচে থাকত। এই সময় আরও একটি ঘটনার কথা স্মৃতিচারণায় তুলে আনেন শঙ্খবাবু। আকাশবাণীর বিভাগীয় দায়িত্বে তখন আরেক কবি-সুহৃদ কবিতা সিংহ। একটি ভাষণ শেষ করে দুজনে বাইরে বেরিয়েছেন। হঠাৎই কবিতা বলে উঠলেন, “লেখাটা খানিক এডিট করে দেব?” নিজের লেখা তিনি নিজেই কাটছাঁট করবেন; আর তার দরকারই বা পড়ল কেন? জানা গেল, রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্প থেকে নেওয়া একটি বিশেষ অংশ নিয়েই আপত্তি। অংশটি হল-
“শশিভূষণ… কহিলেন, ‘জেল ভাল। লোহার বেড়ি মিথ্যা কথা বলে না, কিন্তু জেলের বাইরে যে স্বাধীনতা আছে সে আমাদিগকে প্রতারণা করিয়া বিপদে ফেলে। আর, যদি সৎসঙ্গের কথা বল তো, জেলের মধ্যে মিথ্যাবাদী কৃতঘ্ন কাপুরুষের সংখ্যা অল্প, কারণ স্থান পরিমিত— বাহিরে অনেক বেশি।”
শঙ্খ ঘোষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাদ যদি দিতেই হয়, পুরোটা বাদ যাবে। নয়ত একটি শব্দও এদিক ওদিক হবে না। নিজের বিশ্বাস থেকেই একথা বলেছিলেন তিনি। বিপদ এবারেও কিছু হয়নি। কিন্তু গোটা দেশের যে অবস্থা ছিল তখন, তার থেকে বেরিয়ে আসতে বোধহয় কেউই পারেনি। চারিদিকে ভয়ের পরিবেশ। তার মধ্যেই, লেখা দিয়েই নিজের বক্তব্য জানিয়ে গিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষরা। সেই পরম্পরা অবশ্য আজও থামেনি। কিন্তু এই বৃদ্ধ অবস্থায় পৌঁছেও, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে ধরেছেন তিনি। কলমও তুলেছেন। আর তার জন্য অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও শুনতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি যে ভয় পাওয়ার পাত্র নন!
ঋণ - অল্পস্বল্প কথা, শঙ্খ ঘোষ
Powered by Froala Editor