১৯৮৬ সালে প্রথম একক কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ, তার আগে, ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত ‘তিনজন কবি’ এই শরিকি সংকলনের একজন কবি হলেন বীতশোক ভট্টাচার্য, এই সংকলন থেকেই কবি হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। সেদিক থেকে বিচার করলে, বীতশোক ভট্টাচার্যের কবি-জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে পৌঁছে গিয়েছি আমরা। তিনি যখন জীবিত ছিলেন, সজাগ ও সৃষ্টিশীল ছিলেন, এক বিশেষ পত্রিকায় প্রয়াত কবিদের তালিকায় নিজের নাম মুদ্রিত দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন, প্রতিবাদের উচ্চকিত পন্থায় বিশ্বাস ছিল না তাঁর, নিজেকে সরিয়ে নিতেন, চুপ করে যেতেন। তবুও মৃত্যুর পর যে নীরবতা, সৌভাগ্যত তা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠেনি, তাঁর লেখাপত্র প্রকাশে নতুন নতুন প্রকাশনা উদ্যোগী হচ্ছেন, তাঁর কথা বলা, তাঁকে নিয়ে লেখা, লেখাগুলি সামাজিক মাধ্যমে ফিরিয়ে নিয়ে আসা, আরও অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া, এসবের মধ্য দিয়ে আবার যেন বেঁচে উঠছেন তিনি।
তিনজন কবির আরও একজন হলেন, মণীন্দ্র গুপ্ত, তিনিও সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর সম্পাদিত ‘একবছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা’-য় বীতশোক ভট্টাচার্যের একাধিক কবিতা মুদ্রণের সঙ্গে বিখ্যাত ও আলোকপ্রাপ্ত অনেক কবির মাত্র একটি করে কবিতা মুদ্রিত হয়, সত্তর দশকের গোড়ার দিকেই কফিহাউস আলো করে বসা কবিদের অনেকেই নাকি মেনে নিতে পারেন নি এমন ঘটনা, প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এখান থেকে বোঝা যায়, একেবারে শুরুর সময় থেকেই বীতশোক ভট্টাচার্যকে দূরে সরিয়ে রাখবার মানসিকতাটি ক্রিয়াশীল ছিল, আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে, প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন হওয়ার ফলে বীতশোক ভট্টাচার্যও কোনোদিন কোনো সচেতন প্রয়াসে ‘কলকাতা’-র হয়ে উঠতে চাননি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন যখন, মেদিনীপুর থেকে যাওয়া আসা করেছেন। মেদিনীপুর কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর, বেলুড় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য গিয়েছেন, এই বয়সে এসেও, মেদিনীপুর থেকে যাতায়াত প্রতিবার। কলকাতায় থাকার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাসার ব্যবস্থা ছিল না তাঁর। কোচবিহার এ.বি.এন শীল কলেজে অধ্যাপনার চাকুরি ছেড়ে মেদিনীপুর কলেজে যোগদান করেছেন ১৯৭৮ সালে, এবং সেখান থেকেই অবসর। বারবার এই মেদিনীপুরে ফেরা, মেদিনীপুরের দিকে ফেরা, আমার কাছে একটা প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে আসে, তা এক অর্থে আসলে ভূমির কাছেও ফেরা। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা লিখতে গিয়ে এই ভূমির প্রসঙ্গ এনেছেন তিনি, ভূমির ধারণাটি আরও বিস্তৃত হয়েছে, মেদিনীপুরের গ্রাম দেবতার থানের উল্লিখনে, স্থানীয় কুমোরদের বানানো পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়ায় ভরে থাকে সেসব দেবতার থান। বীতশোক ভট্টাচার্যকে বুঝতে গেলে, এই লোকায়ত প্রেক্ষাপটটি বোঝা জরুরি বলে মনে হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলা কবিতা বাংলার মাটি জল মন আর প্রাণে-র সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চেয়েছে, হাজার বছরের বাংলা কবিতার এটাই নিয়তি। বাংলা কবিতা যতটাই বাংলা ভাষায় লেখা কবিতা, ঠিক ততটাই বাঙালির কবিতা। মেদিনীপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে, মেদিনীপুরের মাটি জল মন ও প্রাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে বীতশোক তাঁর বাংলাকে চিনেছিলেন। মেদিনীপুর কি চিনেছিল তাঁকে?
অনেকেই নিজের লেখার বিষয়ে বীতশোক ভট্টাচার্যের মতামতের প্রত্যাশা করতেন, লেখার খাতা নিয়ে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে যেতেন সবাই। কোনোদিন কাউকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এমন শুনিনি, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের মতোই, প্রত্যেকের লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন, মতামত দিতেন, সংক্ষিপ্ত অথচ মেধাবী সে সকল মন্তব্য। সেসময় একটি কবিতায় লিখেছিলাম, ‘পোস্তপাতার মতো চোখ যার’। পোস্তপাতা দেখেছি কিনা জানতে চেয়েছিলেন উনি। তখনও আমার পোস্তপাতা দেখা হয়নি, মৃদু অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, তাহলে লিখেছো যে! এখন আমি পোস্তগাছ দেখেছি, পাতাও। কিন্তু এই দেখার কথাই কি বলতে চেয়েছিলেন সেদিন?
আরও পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে পত্রিকা প্রকাশ, গ্রেপ্তার কবি শম্ভু রক্ষিত
জীবনানন্দের প্রসঙ্গে একবার লিখেছিলেন, জীবনানন্দর চোখদুটি ‘খুঁটিনাটি দেখা চোখ’, ‘একেবারে সবখানা দেখতে পাওয়া চোখ’। সবখানা দেখতে চাওয়া, জানতে চাওয়া, বুঝতে চাওয়া বীতশোক ভট্টাচার্যেরও স্বভাবের বিশেষ একটা দিক। দেখতে চাইলে, এভাবেই দেখো। জানতে চাইলে, এভাবেই জানা উচিত। স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানন্দ এক স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছিলেন, বেলুড় বিদ্যামন্দির কলেজে তাঁকে ভারতীয় কবিতার ইতিহাস পড়াতে বলা হলে, দ্রাবিড় বংশের মুখ্য চারটি ভাষার কবিতার ইতিহাস পড়ানোর কথাও বলা হয়েছিল সেখানে, বীতশোক ভট্টাচার্য সবিনয়ে জানিয়েছিলেন, ‘দেখুন আমি তো অনেকগুলি ভাষা দেখছি জানি না; এই ধরুন অসমিয়া, ওড়িয়া, হিন্দি, মারাঠি, ভারতীয় ইংরাজি, সংস্কৃত আর উর্দু এগুলি হয়তো আমি পড়িয়ে দিতে পারব, কিন্তু অন্যগুলি কি আমি পারব?’ অনেকগুলি জানতেন না যেমন, কিন্তু যেগুলি জানতেন তার ব্যাপ্তিটাও নিতান্ত কম নয়।
আরও পড়ুন
চলে গেলেন কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যজগতে আরও এক নক্ষত্রপতন
কখন পড়াশুনো করতেন? পড়াশোনার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় ছিল না তাঁর, সংসারে প্রয়োজনীয় কাজপত্র সারা হলে বাকি সময়টুকু পড়াশোনা করেই কাটাতেন। কাজের চাপ থাকলে, রাত্রি জাগতেন, কখনও ভোর রাতেও ঘুমাতে যেতেন, ঘুমাতে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় ছিল না। পাণ্ডিত্যের ছাপ তাঁর কবিতায় পড়েছিল, কিন্তু কবিতা ছাপিয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য বড়ো হয়ে উঠেছিল বলে কখনও মনে হয়নি, যদিও এ-কারণটি দর্শিয়ে অনেকেই তাঁর কবিতাকে এড়িয়ে যান এটিও দেখেছি। তাঁর এত পড়াশুনা নিয়ে একবার বিস্ময় প্রকাশ করায় বলেছিলেন, যত পড়বে যত জানবে ততই একা হবে আসলে। তারপর আরও কিছু কথা, প্রায় বিড়বিড় করে বলার মতো করে বলা, যা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। কিন্তু যতটা শুনতে পেয়েছিলাম, তার মর্মার্থ, এখনও অনুধাবন করে চলেছি।
আরও পড়ুন
পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কবিতা লিখলেন গুলজার, ছড়িয়ে পড়ল নেট দুনিয়ায়
মেদিনীপুর শহরের রাস্তাগুলিতে এখনও তাঁর পায়ের ছাপ রয়ে গেছে। হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন উনি, ওঁর সাহচর্য প্রত্যাশী এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার ওঁর সঙ্গে হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নেই। সঙ্গীর সঙ্গে সাইকেল থাকলেও, কেউ তাতে চড়ে বসবেন না, এটাই নিয়ম। আর মনে থাকবে হাঁটতে হাঁটতে বলা কথাগুলি, ছোটো ছোটো বাক্য, অথচ কী গভীর তার ব্যাপ্তি। কখনো সেগুলির সঙ্গে জুড়ে থাকত তীক্ষ্ণ শ্লেষ সময় সমাজ রাজনীতিকে ছুঁয়ে। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, আলোচনা, অনুবাদ সকলই মুদ্রিত থেকে গেল, কিন্তু এই কথাগুলি? মৃত্যুর আগে পরে যে কটি পত্রিকা তাঁকে নিয়ে সংখ্যা বা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে, কোথাও কোনো সাক্ষাৎকার মুদ্রিত হয়নি। এমন নয় যে, আগে কোথাও তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়নি, কারো কারো কাছে সেগুলির খোঁজ করা হলে এখনও পাওয়া যাবে, যে কোনো কারণেই সেগুলি পুনর্মুদ্রণের চেষ্টা কেউ করেননি। কয়েকজনের সঙ্গে তিনি আড্ডা দিচ্ছেন, বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসবে সে আড্ডায় এবং তিনি বলবেন তাঁর কথাগুলি, পুরো আড্ডাটি রেকর্ড করা হবে, এমন একটি ব্যবস্থাপনার কথা তাঁকে জানানো হলে সম্মত হয়েছিলেন তিনি। প্রস্তুতি চলাকালীন তিনি আবার অসম্মতির কথা জানালেন, সাক্ষাৎকারের প্রয়োজন নেই। এই ঘটনার সপ্তাহ দুই পরে ম্যানেনজাইটিস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় কবি বীতশোক ভট্টাচার্যের। সাক্ষাৎকারের সম্মতি ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, কী হয় এসবে! তারপর নিজেই যোগ করেছিলেন, দেহপট সনে নট সকলই হারায়।
আরও পড়ুন
অন্তিম জন্মদিন কাটল শান্তিনিকেতনেই, কাছের মানুষেরা ঘিরে রইলেন কবিকে
এক বহুল প্রচলিত দৈনিকে, সত্তর দশকের কবিদের নিয়ে আলোচনা বেরোলে বীতশোক ভট্টাচার্যের নাম নেই। আমার কলেজ পড়া বয়স তখন, জিজ্ঞেস করে ফেলি, আপনার নাম নেই কেন? কী করে জানব— এই সংক্ষিপ্ত উত্তরটুকু দেওয়ার পর, এক নীরব দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়েছিলেন অনেকক্ষণ, ভূমির দিকে তাকিয়েছিলেন আসলে, যে ভূমির কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন উনি।
আরও পড়ুন
ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম কারাবন্দি কবি তিনি, মুক্তির দাবিতে সই শঙ্খ ঘোষের
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কবিতাই অস্ত্র তাঁর, বিশ্বের দরবারে আদিবাসী স্বর পৌঁছে দিচ্ছেন ঝাড়খণ্ডের তরুণ কবি