কবিতা, গল্প, সাহিত্য এগুলোর সবই মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র তৈরি করে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যোগাযোগ তৈরি করে জাহাজও। যদি এই দুটো জিনিস এক হয়ে যায়? কোনো ব্যক্তি, যিনি কিনা নাবিক, তিনি একইসঙ্গে পাড়ি দিচ্ছেন শব্দের জাহাজে? কবি ও সম্পাদক জলধি হালদার সেরকমই একজন ব্যক্তি। সমুদ্রই তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে জীবনের যাত্রায়, সেখানেই সঙ্গী করেছেন কলমকে।
নামের সঙ্গে পেশার এমন অভূতপূর্ব মিল সচরাচর দেখা যায় না। এটা কি শুধুই কাকতালীয়? কথাটা বলতেই হেসে উঠলেন জলধিবাবু। জন্মেছিলেন বনগাঁয়, স্বাধীনতার তিন বছর পর, ১৯৫০-এ। নিতান্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কিন্তু বাড়িতে ছিল পড়াশোনার পরিবেশ। তাঁর বাবা, শরৎচন্দ্রের একটি উপন্যাসের চরিত্রের নামানুসারে ছেলের নাম রাখলেন ‘জলধি’। এদিকে বাড়ির কাছ দিয়েই বয়ে যেত ইছামতী। সেই সময়ের ইছামতী ছিল ভরাযৌবনা। বসিরহাট, হাসনাবাদ থেকে বড় বড় নৌকা, বাজরা এসে ভিড়ত। সেখানে বোঝাই থাকত বিচালি। দূর থেকে দেখলে মনে হত, একটা জাহাজ আসছে!
আরও পড়ুন
‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী, ছাপ রেখেছেন রাজনীতিতেও
ছোটোবেলার সেই মুহূর্ত থেকেই নদীর সঙ্গে, বলা ভালো জলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তাঁর। আর স্বপ্নে ছিল জাহাজ। কেমন দেখতে ওগুলো? সমুদ্র কত বড়ো? এই প্রশ্নেই ছুটে যাওয়া খিদিরপুরে। এমনিতেও তখন সংসারের টানাপোড়েনও ছিল। সময়টা সত্তরের দশক। গোটা বাংলা তখন ফুটছে। নকশালবাড়ির আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। নিজের ‘জীবনযুদ্ধের লড়াইতে’ তখন জলধি হালদারও। খিদিরপুরে গিয়ে জাহাজের ওপর ট্রেনিং নেন। তারপর যুক্ত হন জাহাজে। অবশেষে তাহলে ইছামতীর ছেলে সমুদ্রে এসে পড়ল…
কিন্তু জীবন তো এতটা সহজ নয়। খিদিরপুরে সুযোগ না হওয়ায় তাঁকে পাঠানো হল মুম্বাইতে। সেই সময়ের বিখ্যাত সিন্ধিয়া কোম্পানিতে ট্রেনি হিসেবে যোগদানের সুযোগ আসে। বিশাল ব্যাপার! কিন্তু বাধ সাধল অন্য জায়গায়। বাঙালি পরিচয় জানার পর, নিয়োগপত্র বাতিল করে দেওয়া হয় জলধিবাবুর। কারণ? বাংলা থেকে এসেছে, বাঙালি; তার মানেই সে ‘নকশাল’। সত্তরের ভীতি এতদূর অবধিও পৌঁছেছিল। অবশেষে জায়গা পান শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়াতে।
কিন্তু অল্পদিনেই ভারতের পাট চুকল তাঁর। অল্প কিছু জামা কাপড় ও সামগ্রী নিয়ে পাড়ি দিলেন ডেনমার্ক, কোপেনহাগেন। বলা যায়, নাবিকের জীবন, সমুদ্রের জীবনের সেই শুরু। তখন থেকে ২০১০-এ অবসরের আগে পর্যন্ত এই পরিব্রাজকের ভূমিকাতেই তিনি দেখেছিলেন সবটা। দেখেছেন বহু দেশ। সামিল হয়েছেন নানা অ্যাডভেঞ্চারে। একটু পাশ থেকেই অন্যভাবে দেখেছেন জীবনটা।
আরও পড়ুন
নিজে গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্র, টেনিদা’কে টানা সাত বছর ফেল করালেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
এই পুরো যাত্রায় আরও একটি জিনিস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। কবিতা, সাহিত্য। অবশ্য ছোটো থেকেই ছিল সেসব। কিন্তু কখনও সামনে আসতে চাননি। আড়ালে থেকে, নিজের মতো করে পড়াশোনা, লেখার কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। নিভৃতেই চলছিল চর্চা, যাপন। এইভাবেই লিখে ফেলেছিলেন টি এস এলিয়টের ওপর একটি গদ্য রচনা। সেটাই প্রকাশিত হয়েছিল একটি লিটল ম্যাগাজিনে। জলধি হালদারের প্রথম প্রকাশিত রচনা।
নিজের ইচ্ছা মতো লিখতেন। নিজের জীবন, জলের জীবন, সেই সঙ্গে সমকাল— সমস্ত কিছু ছুঁয়ে যেত তাঁর কলম। এক সময় ‘শিস’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে বন্ধু নলিনী বেরা, স্বপ্নময় চক্রবর্তীদের উৎসাহে একের পর এক লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ছোটো-বড়ো নানা পত্রিকায় স্থান পায় তাঁর লেখা। বেরোতে থাকে বইও। ‘বিষকরবী’, ‘ফৌজদার হাঁস মেরেছে’, ‘নুড়ি পাথরের শব্দ’ একের পর এক বই এসেছে সামনে। কিন্তু সেভাবে কখনও চাননি এমন খ্যাতি বা প্রচার। এইভাবেই একদিন লিখে ফেলা ‘সমুদ্রতান্ত্রিক’। যে বই তাঁকে এনে দিল ‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার’। এখনও লিখছেন, নিজের মতো করে। নিভৃতিই তাঁর আশ্রয় এখন। বনগাঁয় নিজের বাড়িতে বসে একমনে কাটিয়ে যান শব্দের মধ্যে।
নকশাল আন্দোলনের উত্তাল সময়ে বড় হয়েছেন তিনি। বর্তমানে সহ-সম্পাদক হিসেবে যে পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন (‘এবং অন্যকথা’), সেখানে প্রকাশ করেছেন নকশালবাড়ির ৫০ বছর পূর্তি নিয়ে সমৃদ্ধ একটি সংখ্যা। এখনও তাঁর কথায় উঠে আসে সেই প্রসঙ্গ। “হ্যাঁ, এই আন্দোলনে কিছু ভুলভ্রান্তি ছিল। কিছু কাজে ত্রুটি ছিল। কিন্তু নকশাল আন্দোলন ছিল প্রকৃত অর্থেই একটি আন্দোলন। এর উদ্দেশ্য ছিল অনেক বড়ো। অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল আমাদের এই নকশালবাড়ি। সেইজন্য বহু মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাও কোনো কিছুর পরোয়া না করে এই আন্দোলনে নেমেছিল। তারা তো বোকা নয়! কিন্তু লক্ষ্যটা যা ছিল, তার জন্য আরও হাজার বছর পরেও এটি প্রাসঙ্গিক থাকবে।”
আরও পড়ুন
‘দেশ’ পত্রিকায় বাতিল কবিতা, নজরদারি আকাশবাণীতেও – জরুরি অবস্থার শিকার শঙ্খ ঘোষ
‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।’ যে-কোনো সময়, ভালো-খারাপে এই লাইনটা সবার আগে এগিয়ে আসে আমাদের মধ্যে। আরেকটা ২১ ফেব্রুয়ারির মুহূর্তে দাঁড়িয়ে জলধিবাবুও সেই শঙ্কাই রাখলেন খানিক। “বাংলা ভাষা যে এই জায়গায় পৌঁছেছে, তার জন্য আমরা বাঙালিরাই দায়ী। সেই সঙ্গে দায়ী সরকারও। বাংলা ভাষাকে ঠিকমতো ব্যবহার করা হয়নি। যেকোনো সরকারি কাজে বাংলাকে ব্যবহার করা হয় না। অবশ্য, ইতিহাস বলে বাংলা কখনই ক্ষমতার ভাষা ছিল না। ইংরেজি ভাষার তো একটা আগ্রাসন তো আছেই। ইংরেজি দরকারও। কিন্তু, বাংলা কখনও কোনো সরকারি কাজে বা অন্যান্য জায়গায় ব্যাপকভাবে আসেনি। সরকার করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। নব্বইয়ের দশকে রাইটার্সে যখন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, তখন নিচে স্লিপে বাংলায় নাম লিখতাম। সেই সময়ও সেটা দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত লোকে। যেন পড়াশোনা না জানা, ভিনগ্রহের একটি জীব।
ঠিক এখানেই আমাদের সমস্যাটা। মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য সম্মান আমরা কেউই করিনি। এমনকি, চাকরিতেও বাংলা ভাষার জায়গা নেই। আমরা বাঙালিরাই সম্মান রাখতে পারি না ভাষার। অন্য প্রদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সেই ভাষা ব্যবহার করি। তাঁরা কিন্তু এই কাজটি করেন না। আমরা, বাঙালিরা করি। কেন? আমরা নিজেরাই কি শেষ করছি না নিজেদের?”
সমস্ত আলাপচারিতার শেষে এই প্রশ্নটাই বারবার ঘুরতে লাগল মাথায়। আর এভাবেই একরাশ প্রশ্ন, মন খারাপ, স্বপ্ন নিয়ে বনগাঁয় নিজের ঘরের বাতিটি নেভালেন জলধি হালদার। ক্লান্তিতে বলে ওঠেন- “এইভাবে আমি প্রতিদিন জীবিত থাকি”। নিজের সমুদ্র স্বপ্নের ভেতর ঘুরতে থাকে শব্দ, কবিতা। ঘুরতে থাকে আস্ত ভারতবর্ষ। ইছামতীর ছেলেটার চোখ আজ খুঁজছে তরুণদের। যাঁদের চোখ দিয়ে তিনিও দেখতে পারেন নতুন ভোর। যেখানে আবারও নাবিক সেজে বেরিয়ে পড়বেন নতুন যাত্রার দিকে…