“পৃথিবীর প্রতিটা শিশুই এক একজন শিল্পী। আসল সমস্যাটা হল সেটাকে টিকিয়ে রাখা এবং সেই শিল্পসত্ত্বার সঙ্গে এগিয়ে চলা”— এই কথাটি বিভিন্ন সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। লোকের উৎসাহ বাড়াতেও এরকম কথা বলে থাকেন অনেকে। কিন্তু ওপরের বক্তব্যটি যিনি বলেছিলেন, তিনি কতটা সঙ্গে রাখতে পেরেছিলেন শিল্পকে? এর উত্তর দিতে বেশি সময় নষ্ট হবে না। দুটো শব্দেই দেওয়া যায়; কারণ লোকটির নাম যে পাবলো পিকাসো (Pablo Picasso)!
জন্মের পরই তাঁর মুখ থেকে প্রথম যে শব্দটি বেরোয়, সেটি ‘পিজ’। পুরো কথাটি হল ‘লাবিজ’, স্প্যানিশ এই শব্দের মানে হল পেনসিল। বাস্তবিকই, ছোটো থেকেই পিকাসোর হাতে উঠে গিয়েছিল পেনসিল, ইজেল, ক্যানভাস। ছিল রঙের দুনিয়া; বাকি সরঞ্জাম বলতে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ আর কল্পনা। মৃত্যু সবসময় তাঁর গায়ে আঁচড় কেটেছে। সে প্রিয় বোনের অকালমৃত্যুই হোক, বা প্রেমে আঘাত পেয়ে বন্ধুর আত্মহত্যাই হোক। জীবন একসময় ছিল নানা রঙে রঙিন; সেখানেই ফুটে উঠল দুটো রং— নীল আর কালো। তারপর আবারও বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, পিকাসোর জীবনের এই বাঁক বদল যখনই হয়েছে, তখনই বদলে গেছে ক্যানভাসের রং। কখনও উজ্জ্বল, কখনও গভীর বিষাদের মতো। জীবনটাই যে আস্ত চিত্রনাট্য। আর পিকাসো তো শুধু সেটার ওপরেই তুলি বোলাচ্ছেন!
এই সম্পর্কে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা দরকার। একদিন পিকাসো একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গেছেন। ততদিনে তিনি কিংবদন্তি, বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ও প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী। খাওয়ার সময়ই একজন এগিয়ে এলেন তাঁর কাছে। বিনীতভাবে জানালেন তাঁর অনুরোধ, এই ন্যাপকিনের ওপর কি কিছু এঁকে দেবেন? যা অর্থ চাইবেন দেব…। পিকাসো পকেট থেকে চারকোল পেনসিল বার করে একটি ছাগল আঁকলেন। যেই ওই ব্যক্তি ন্যাপকিনটি নিতে যাবেন, পিকাসো অর্থ চেয়ে বসলেন। এই আঁকার বিনিময় তাঁকে এক লাখ ডলার দিতে হবে! ব্যক্তিটি ঘাবড়ে গেলেন। তিরিশ সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে একটি ছাগল আঁকলেন, তার জন্য এত টাকা? পিকাসো একটু তাকালেন, তারপর বললেন “না, তুমি ভুল বলছ। ওই একটি ছাগল আঁকতে আমার চল্লিশ বছর সময় লেগেছে!”
গোটা জীবনে ৫০ হাজারটি শিল্পকর্ম করে গেছেন। শুরুটা হয়েছিল আট বছর বয়সে; মৃত্যুর আগের দিন গিয়ে যা শেষ হয়। তবে শিল্পী মানেই যে ভাবনার জগতে আবিল হয়ে থাকবেন, তা তো নয়। সমকালকে জহুরির চোখ দিয়ে দেখবেন শিল্পী, চিনে নেবেন, ফুটিয়ে তুলবেন তাঁর কাজে। ঠিক এটাই ভাবতেন পিকাসো। জীবনে একের পর এক প্রেম এসেছে; এসেছে মৃত্যু, বিচ্ছেদ। কিন্তু আয়নার দিকে তাকিয়ে গেছেন, তাকিয়েছেন পৃথিবীর দিকে। তাই জাঁ ককতোর ব্যালে অনুষ্ঠানের মঞ্চ সজ্জা, পোশাক পরিকল্পনার দায়িত্ব যখন পেলেন, তখন শুধু শিল্পের নন্দনতত্ত্বের দিকে নজর দেননি। তাঁর চোখে উঠে এসেছিল যুদ্ধ, খুন, অভাব। দর্শকরা এই ভয়ংকর বাস্তবতাকে নিতে পারেননি একেবারেই।
একবার পিকাসোর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন এক অতিথি। এসেই তো অবাক! গোটা বাড়িতে রয়েছে নানা জিনিস; কিন্তু পিকাসোর নিজের আঁকা কোনো ছবি নেই। এরকম কেন? আর থাকতে না পেরে শেষে প্রশ্নটি করেই ফেললেন আসল মানুষটিকে। পিকাসো প্রথমেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর বললেন “কী করে থাকবে? পিকাসোর ছবিগুলোর যে অনেক দাম! আমার এত টাকা কোথায় যে ওই ছবি কিনব আর সাজিয়ে রাখব?” রসিকতাই হবে, কিন্তু শিল্পের প্রতি ছিলেন সৎ। রাতের অতিথি ছিলেন তিনি। সেই সময়ই সমস্ত কিছু ফুটে উঠত তাঁর চোখে। পাবলো পিকাসো, তাঁর চোখ আর ক্যানভাস— সবকিছু একসঙ্গে মিলে গিয়ে তৈরি হয়েছিল অন্য পৃথিবী।
Powered by Froala Editor