স্পেনসেস থেকে গ্র্যান্ড— কেমন ছিল কলকাতার পুরনো হোটেলগুলি?

কল্লোলিনী কলকাতা। সকাল হোক বা সন্ধে, এই শহরের পরতে পরতে লেগে আছে ব্যস্ততা। রাস্তাঘাট, দোকানপাট তো বটেই, আনাগোনার কমতি নেই নামী-অনামী হোটেলগুলিতেও। কখনও ভেবেছেন, যে শহরের অলিগলিতে এখনও ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা চিহ্ন, সেই তিলোত্তমার পুরনো হোটেলগুলোর গল্প কীরকম? কেমন ছিল সেইসব?

কলকাতার সবচেয়ে পুরনো হোটেল কোনটা, সেটা নিয়ে অনেক মতানৈক্য আছে। রয়েছে সঠিক তথ্যের অভাব। অবশ্য এই হোটেল নামক রাজকীয় ব্যাপারটার আগমন ইংরেজদের হাত ধরে। তার আগে অবশ্য ছিল বিভিন্ন চটি। সেরকম হলে আগে মুদির দোকানেও যে রাত কাটানো যেত, তার কিছু বর্ণনা আমরা গল্প উপন্যাসেই পড়েছি। তবে এখনকার হোটেল বলতে আমরা যা বুঝি, সেই ব্যাপারটা মূলত এসেছে ইংরেজদের সঙ্গেই।

কলকাতার হোটেল বলতে সবার আগে যে নামটি মাথায় আসবে, সেটি স্পেনসেস হোটেলের। রাজভবনের দরজা ধরে পাঁচ মিনিট মতন হাঁটলেই হোটেলটি নজরে আসে। বলা ভাল, নজরে আসত। এখন হোটেলটি বন্ধ হয়ে গেলেও, বাঙালির অত্যন্ত কাছের ছিল এই হোটেল। শঙ্করের ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসের দৌলতে, এবং অবশ্যই পরে চলচ্চিত্র হওয়ার কারণে হোটেলটি আরও বহু লোকের কাছে পৌঁছে যায়। বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে এইখানেই উঠেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তবে শেষের দিকে হোটেলটির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। তারপর একদিন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় হোটেলের দরজা। কিন্তু স্যাটা বোসদের আস্তানাকে এত সহজে ভুলে যেতে পারি আমরা?

প্রধানত এই স্পেনসেস হোটেলকেই কলকাতার সবচেয়ে পুরনো হোটেল বলে ধরা হয়। যদিও ফলতার দিকে এক সময় এইরকমই একটি পুরনো ইংলিশ হোটেল ছিল। সেই সময় ইউরোপ থেকে অনেক জাহাজ এসে ভিড়ত এখানে। তাদের থাকা খাওয়ার জন্যই এই ইংলিশ হোটেল শুরু হয়েছিল। তবে এর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তবে খাস কলকাতার বুকে আরও কিছু পুরনো ও ঐতিহ্যশালী হোটেল ছিল। যেমন ছিল ব্রিস্টল হোটেল, তেমনই ছিল উইলসনসাহেবের হোটেল, গ্র্যান্ড হোটেল। শেষোক্ত দুটি হোটেল আজও নিজেদের নামের গৌরব বজায় নিয়ে চলেছে। শুধুমাত্র উইলসনসাহেবের হোটেলের নামটি বদলে গেছে। সেটি এখনকার গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল।

সেই সময় খুব যে বেশি হোটেল তৈরি হয়েছিল, তা নয়। আর এই সমস্ত হোটেলে থাকা ছিল অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। সাধারণ চাকরি নিয়ে আসা ইংরেজরাও থাকতে পারত না এখানে। তখনকার হিসেবে এই সব হোটেলে থাকা-খাওয়ার খরচা ছিল দিনে দশ-বারো টাকা। আবার ব্রিস্টল হোটেলের মতো জায়গাতে না থেকেও সেখানকার রেস্তোরাঁতে খাওয়া যেত। এখানে অবশ্য তুলনায় খাবার ছিল অনেক সস্তা, দেড় টাকা! আর পদও পাওয়া যেত অনেক বেশি।  

সে-আমলের বেশিরভাগ হোটেলই এখন ইতিহাসের পাতায়। বেশ কিছু আবার টিকে আছে রাজকীয় ভঙ্গিতেই। সে যাই হোক, যে দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে চলেছে কলকাতা, তার শরীরে এসব চিহ্নও তো নেহাৎ উপেক্ষার নয়, তাই না?