“লেনিনগ্রাদকে অনাহারে মরতে হবে”—১৯৪১ সালের ৮ নভেম্বর মিউনিখে ঘোষণা করলেন হিটলার। তার ঠিক দু’মাস আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনগ্রাদ (Leningrad) বা বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর আক্রমণ করেছে নাৎসি বাহিনী। পরবর্তী প্রায় ৯০০ দিন অবরুদ্ধ করে রাখা হয় গোটা শহরটিকে। হিটলারের ঘোষণা সত্যি করে সাত লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান অনাহারে আর ঠান্ডায়। যার মধ্যে ছিলেন ভাভিলভ শস্য গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরাও। চাইলে, সেদিন হয়তো অনায়াসে নিজেদের জীবন বাঁচাতে পারতেন তাঁরা। কিন্তু অনাগত ভবিষ্যতের স্বার্থে তাঁরা বেছে নেন মৃত্যুকেই।
লেনিনগ্রাদে প্রবল ঠান্ডা থাকে প্রায় সারা বছরই। শীতকালে তাপমাত্রা কখনও কখনও নেমে যায় মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে। এদিকে শহর জুড়ে হিটলারের সেনাবাহিনীর দৌরাত্ম্যে ফুরিয়ে আসছে খাদ্যের ভাণ্ডার। রাস্তায় শোনা যাচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। মৃত্যু হয়ে উঠছে নিত্যসঙ্গী। ভাভিলভ শস্যকেন্দ্রের অবস্থাও একই রকম। অথচ, তাঁদের হাতে তখন মজুত রয়েছে চাল, গম, ভুট্টা, আলু-সহ প্রায় চল্লিশ হাজারের খাদ্যশস্যের চারাগাছ। কীভাবে? তার জন্য পিছিয়ে যেতে হবে আরো কয়েক বছর। ১৯২৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ভিদবিজ্ঞানী নিকোলাই ভাভিলভের (Nikolai Vavilov) প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে এই প্রতিষ্ঠানটি। যাঁকে বলা হত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শস্য সংগ্রাহক। তার কিছু বছর আগেই দেশে এসেছিল এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। সেটা আরো চিন্তিত করেছিল তাঁকে। সোভিয়েতের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে ঘুরে তিনি দেশের খাদ্যসমস্যা সরেজমিনে তদন্ত করেছিলেন। গবেষণার জন্য বেরিয়ে পড়েন বিদেশযাত্রাতেও। পাঁচটি মহাদেশের অন্তত ৬৪টি দেশ ঘুরে সংগ্রহ করেন কয়েক হাজার খাদ্যশস্যের নমুনা।
তারপর লেনিনগ্রাদের গবেষণাকেন্দ্রে শুরু করেন সেগুলির জিনগত পরীক্ষানিরীক্ষা। যুক্ত হন আলেকজান্ডার শ্চুকিন (Alexander Stchukin) ও দিমিত্রি ইভানভ বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানীরাও। চারের দশকের শুরুতেই তাঁরা তৈরি করে ফেলেন প্রায় দু-লক্ষ শস্য। আর তারপরই আক্রমণ করে হিটলারের বাহিনী। এই দুই বিজ্ঞানীই তখন মূলত ‘ভাভিলভ’-এর দায়িত্বে। কিন্তু গবেষণাকেন্দ্রের বারো জন বিজ্ঞানীর কেউ শেষ পর্যন্ত হাত দেননি সেই শস্যভাণ্ডারে। বরং নিয়মিত পাহারা দিতেন ষোলোটি ঘর। তবে হ্যাঁ, একা ছাড়া হত না কাউকে। যদি কেউ নতিস্বীকার করে ফেলে ক্ষুধার জ্বালার কাছে। কিন্তু এভাবে কতদিন বেঁচে থাকা যায়? ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে নিজের কাজের টেবিলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শ্চুকিন। ক্রমে ইভানভ ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদেরও একই পরিণতি হয়। শেষ পর্যন্ত কেউ হাত দেয়নি শস্যভাণ্ডারে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন ভালোবেসে, তবু ভবিষ্যতের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলেন খাদ্যের জোগান। পরবর্তীতে বিশ্বের বহুদেশে পাঠানো হয় ‘ভাভিলভ’-এ তৈরি শস্য। ফলাফল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, প্রাথমিকভাবে এই শস্যগুলি পরীক্ষায় সফল হয়েছিল বলেই ধরে নেওয়া হয়।
কিন্তু বিজ্ঞানী ভাভিলভের কী হল? তাঁর সংস্থার বিজ্ঞানীরা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন, তখন তিনি কি দূরে কোথাও সুখস্বপ্নে দিন কাটাচ্ছেন? না, তিনিও তখন জেলে। বিদেশে নয়, খোদ স্তালিনের সোভিয়েতে। শুরুটা হয়েছিল বৈজ্ঞানিক মতবিরোধ দিয়েই। স্তালিন-ঘনিষ্ঠ বিজ্ঞানী ট্রফিন লাইসেঙ্কোর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্যে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এমনকি লাইসেঙ্কোর পদ্ধতির সমালোচনা করেন খোলাখুলিভাবেই। রাষ্ট্রের মাথায় থাকা অনেকেরই সেক্ষেত্রে মনে হয়েছিল যে, ভাভিলভ বকলমে সোভিয়েতের নতুন কৃষিব্যবস্থারই সমালোচনা করছেন। ১৯৪০-র আগস্টে পূর্ব ইউরোপের সীমান্তে শস্য সংগ্রহের সময় কেজিবি-র হাতে বন্দি হন ভাভিলভ। সোভিয়েতের কুখ্যাত গুলাগ-এ তাঁর কুড়ি বছরের কারাদণ্ড হয়। পিছনে যে লাইসেঙ্কোর প্রত্যক্ষ মদত ছিল, এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন অনেকেই। কিন্তু সরাসরি বলার সাহস ছিল না কারোরই। কারণ তাঁর বিরোধী তিন হাজার বিজ্ঞানীকে বিভিন্নভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল মাত্র ছয় বছরের মধ্যে। ভাভিলভকে অবশ্য বেশিদিন কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়নি। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে মৃত্যুর মাধ্যমে সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটে তাঁর। জেলের কঠিন অবস্থায় অনেক রোগ বাসা বেঁধেছিল তাঁর শরীরে, আবার অনেকের মতে অনাহারের কারণেই মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে ভাভিলভের।
আরও পড়ুন
‘ঘোড়া ট্রেন’ এবং স্যার গঙ্গারাম, ইতিহাসের অতলে এক আশ্চর্য যাত্রা
একে কী বলা হবে? কাকতালীয়? ভাভিলভের সংস্থার শস্যের জন্য যখন নাৎসিদের সামনে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা, তখন অন্যদিকে স্তালিনের সোভিয়েতে জেলবন্দি অবস্থায় মৃত্যু ঘটে ভাভিলভের। কোথাও যেন এক বিন্দুতে মিলে যায় দুটি দৃশ্য। সাধারণ মানুষের ন্যূনতম যে খাদ্যের দাবি, তাই হয়তো চিনিয়ে দেয় শাসকের প্রকৃত সত্তাকে।
আরও পড়ুন
গুজব ছাপিয়ে গেছে ইতিহাসকে, আজও সক্রিয় ৬০০ বছর পুরনো ঘড়ি
Powered by Froala Editor