খুলনার ফাতেমা জুয়েলার্সের সঙ্গে জড়িয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কীভাবে?

বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর খুলনা। শুধু তাই নয়, খুলনা জেলার সদরও অবস্থিত এই শহরে। দেশভাগের আগেকার দিনগুলিতে উঁকি দিলে, ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে খুলনার বিপ্লবীদের অবদান কিছু কম ছিল না। তেমনই একজন বিপ্লবীর আহ্বানে খুলনায় একটি দোকানের উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। তখনও তিনি ‘নেতাজি’ হননি। এই গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে বর্তমান খুলনাবাসীদের কতজন ওয়াকিবহাল, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ থেকেই যায়!

খুলনার একটি গ্রামের জমিদার ছিলেন চট্টোপাধ্যায়রা। সেই বংশেরই নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় জড়িয়ে পড়েন বৈপ্লবিক আন্দোলনে। ত্রিশের দশকে, বিপ্লবীদের দৌরাত্ম্যে ভীত ইংরেজ সরকার অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে, বেশ কয়েকজন বিপ্লবী ব্যবসায়ী সেজে খুলনায় আত্মগোপন করেন। তেমনই এক বিপ্লবী নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। ১৯২৮-২৯ সালে, সারা বাংলা ছাত্র আন্দোলনে নারায়ণ ছিলেন খুলনা জেলার নেতা। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে আট বছর জেল খাটেন তিনি। তারপর মুক্তি পেয়ে, খুলনা জেলার কংগ্রেস কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ইতিমধ্যে, সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস ছেড়ে তৈরি করেছেন ফরোয়ার্ড ব্লক। নারায়ণ কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দেন ফরোয়ার্ড ব্লকে।

ইংরেজদের চোখকে ধুলো দিতে এরপর একটি দোকান খোলার পরিকল্পনা করেন নারায়ণ। উদ্দেশ্য ছিল, ব্যবসায়ী পরিচয়ের আড়ালে রাজনৈতিক কাজ চালিয়ে যাওয়া। সেইমতো, খুলনা শহরের হেলাতলার মোড়ে একটি বইয়ের দোকান চালু করার প্রস্তুতি নেন তিনি। নাম ঠিক হয় ‘চট্টোপাধ্যায় ব্রাদার্স’।

ততদিনে নতুন রাজনৈতিক দল ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রচারের জন্য বাংলার বিভিন্ন জেলায় সফর করছেন সুভাষচন্দ্র। সেটা ১৯৩৯ সাল। ৩০ ডিসেম্বর বরিশাল হয়ে খুলনা এলেন তিনি। হাজার কর্মসূচি ও ব্যস্ততার মধ্যেও, নারায়ণের আহ্বানে নতুন বইয়ের দোকানটির উদ্বোধন করেন। সুভাষচন্দ্রের হাতে চট্টোপাধ্যায় ব্রাদার্সের উদ্বোধন ছিল সেকালের খুলনা শহরের অন্যতম আলোচিত একটি ঘটনা।

নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এরপর নেন খুলনার ফরোয়ার্ড ব্লক জেলা কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব। যোগ দেন কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলনেও। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিন বছর কারাবাস হয় তাঁর। দেশভাগের পর, খুলনায় দুর্গতদের জন্য দীর্ঘদিন কাজও করেছেন তিনি। প্রৌঢ়ত্বে পাকিস্তান সরকারের উৎপীড়নে বাধ্য হয়ে স্বদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। মারা যান পশ্চিমবঙ্গেই, ১৯৮৯ সালে।

এদিকে, কালের নিয়মে বন্ধ হয়ে যায় চট্টোপাধ্যায় ব্রাদার্সও। তবে ভেঙে ফেলা হয়নি সে-দোকান। সেখানেই শুরু হয় ফাতিমা জুয়েলার্সের যাত্রা। আজও খুলনা শহরে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে দোকানটিকে। নাম বদলেছে, ব্যবসার ধরণও; বদলায়নি শুধু ইতিহাসের তথ্য। বিপ্লবী নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর উদ্যোগের কথা। সঙ্গে সুভাষ-স্মৃতি তো রয়েইছে!

Powered by Froala Editor