হ্রদে ভেসে উঠল অদ্ভুতদর্শন প্রাণী, ‘লেক নেস মনস্টার’ নিয়ে আলোড়ন পৃথিবীতে

স্কটল্যান্ডের লচ নেস। বিশাল বড়ো একটি লেক। চারিদিকের সুন্দর দৃশ্য, গাছপালা; সেইসঙ্গে লেকের পরিষ্কার জল। যেকোনো ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে অত্যন্ত সুখকর জায়গা এটি। সেইরকমই ভাবনা ছিল রবার্ট কেনেথ উইলসনের। পেশায় ডাক্তার এই ভদ্রলোক লচ নেসের ধারে দিব্যি ঘুরছিলেন। সবকিছু ঠিক ছিল; নাকি কিছুই ঠিক ছিল না? হঠাৎ লেকের দিকে তাকাতেই কিছু একটা চোখে পড়ল তাঁর। প্রথমে বুঝতে পারলেন না; পরে দেখে চমকে গেলেন তিনি। ঘাবড়েও গেলেন। যা দেখছেন, ঠিক দেখছেন তো? সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরায় ছবি তুললেন রবার্ট। পরে সেই ছবি ও ‘সংবাদ’ ডেইলি মেলে ছাপতেও দেন। যে ছবি গোটা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দেয়। কী ছিল ওই ছবিতে? টলটলে লেকের জল, তারই মাঝখানে একটা ছায়া মতো কিছু। মানুষ নয়; একটি জন্তু। কিন্তু এমন জন্তু কি সম্ভব? যার মাথা আর পেশিবহুল গলা বিশাল লম্বা। অনেকটা ডাইনোসরের মতো! বিংশ শতকে এমন প্রাণী রয়েছে কী করে! সেই দিন পৃথিবীর রহস্যের তালিকায় আরও একটি সংযোজন ঘটল, সম্ভবত অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ সংযোজন। লেক নেসের রহস্যময় প্রাণী…

অবশ্য একটু ভুল হয়ে গেল কথায়। সেইদিন প্রাণীটির ‘ছবি’ সবার সামনে এসেছিল। কাহিনি অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল গোটা বিশ্বে। স্কটল্যান্ডের লোককথা দিয়ে শুরু করা যাক। সেখানে লেক নেসের উল্লেখ তো আছেই; সেইসঙ্গে ওই লেকে বসবাসকারী একটি ‘বিশেষ প্রাণী’র বর্ণনাও দেওয়া আছে। যার গলা লম্বা, শরীরও বেশ বড়ো, আর তার বসবাস লেকের গভীর অংশে। এরকম তো কত লোককথা, কাহিনি সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে আছে। এটিও হয়তো সেরকমই একটি। কিন্তু শুধু লোককথায় থেমে থাকল না ‘নেসি’। হ্যাঁ, আদর করে ওই প্রাণীটির এই নামই দিয়েছে বিশ্ব।

প্রথম লিখিত আকারে প্রাণীটির বর্ণনা পাওয়া যায় ৫৬৫ অব্দে। আদমনানের লেখা বই ‘লাইফ অফ সেন্ট কলোম্বা’তে বর্ণনা পাওয়া যায় এই প্রাণীর। বলা ভালো, এখানেই মানুষের ‘মুখোমুখি’ হল নেসি। আইরিশ পাদ্রি সেন্ট কলোম্বা নাকি নেস নদীতে এই প্রাণীর সঙ্গে লড়েছিলেন। সময়টা খেয়াল করুন, ষষ্ঠ শতক। বর্ণনা সেই একই। লম্বা গলা, ভারী শরীর। সেই সঙ্গে আরও একটা যোগ হল; এটি নাকি মাংসখেকো। এর পরের গল্পের জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনেকগুলো শতাব্দী। ১৮০২-এ অ্যালেক্সান্ডার ম্যাকডোনাল্ড একইরকম একটি প্রাণীকে দেখতে পান লেক নেসে। এইভাবেই ঘটনা পরম্পরা চলতে থাকে। যত লেক নেসের অদ্ভুত জন্তুটির কথা বাইরে আসতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে গল্পের সংখ্যা। মানুষের কল্পনা তার সীমা বিস্তার করতে থাকে।

এতদিন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিংশ শতকে এসে সেই ‘খরা’ কাটল। তার আগে জর্জ স্পাইসার বলে এক ব্যক্তি আবারও এই প্রাণীর দেখা পান। এবার তফাৎ হল, তিনি একেবারে মেপে, উচ্চতা গঠন ইত্যাদি সমস্ত নিয়ে তৈরি হয়ে বলেছিলেন। কিন্তু প্রমাণ? এমন সময়ই ১৯৩৪ সালে ঘটল বিশেষ ঘটনাটি। প্রতিবেদনের শুরুতেই যে গল্পটির কথা বলা হয়েছে। গোটা পৃথিবীতে এই ছবি বিখ্যাত ‘সার্জনের ফটোগ্রাফ’ হিসেবে। এই ছবিটি সামনে আসার পর সবাই একটু নড়েচড়ে বসল। কী আছে লেক নেসের জলের তলায়? সত্যিই কী কোনো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী? নাকি মনের ভুল, কল্পনা?

গবেষণা আজও চলছে। উঠে আসছে নানা রকম সম্ভাবনা, তথ্য। কারোর মতে ছবিটি ভুয়ো; কেউ আবার অস্বীকার করে দিচ্ছেন না প্রাণীটির কথা। বিশ্বের প্রাণীজগতের কতটা আর জানতে পারছি আমরা! আবার অনেক গবেষক বলেছেন এটি তিমি, বা হাঙর জাতীয় বড়ো কোনো সামুদ্রিক প্রাণী বা সিল হতে পারে। এমনকি, ১৯৫৪ সালে শব্দতরঙ্গের পরীক্ষা করে বিশেষ কিছুর অস্তিত্বের সন্ধান পান বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সেটি কী, তা জানার আগেই ওই আওয়াজ মিলিয়ে যায়। কিংবা, এসব কিচ্ছু নয়; একটি হাতি জলে ডুবেছিল, তার লম্বা শুঁড়টা বেরিয়ে ছিল— এমন ধারণার কথাও বলেছেন অনেকেই।

তবে সাম্প্রতিক সময় বেশ কিছু নতুন তথ্য উঠে এসেছে; সবটাই অবশ্য পরীক্ষা সাপেক্ষ, প্রমাণিত হয়নি কিছু। বিজ্ঞানীদের মধ্যে দুটো তথ্য দেখা যাচ্ছে। এক, ওখানে কোনো প্রাগৈতিহাসিক জলজ প্রাণী নেই। হয়তো এই প্রাণীটি কোনো বড়ো ইল মাছ জাতীয় কিছু হবে। কারণ, লেক নেস ইলদের একটি বিশেষ আড্ডার জায়গা। এছাড়াও কয়েকজন আবার বলছেন, হয়তো সত্যিই একসময় নেসি’র বড়ো কোনো প্রাণী ছিল। তার প্রজাতির সেটিই ছিল শেষ অস্তিত্ব। আজ তারা বিলুপ্ত হয়ে এছে। তত্ত্ব অনেক, সম্ভাবনা অনেক। সেখানেই হয়তো লুকিয়ে আছে সত্য। কিন্তু এখনও শেষ হয়নি এই রহস্য। ছবির ওই ছায়ার মতোই আড়ালে থেকে গেছে স্কটল্যান্ডের লেক নেসের ওই অদ্ভুত ‘দৈত্য’।