'তুমি অত বই লিখো না', রবীন্দ্রনাথকে বলে বসলেন ছোট্ট মহাশ্বেতা

লাশকাটা ঘরে শুয়ে আছে ব্রতী। সে স্বপ্ন দেখেছিল বিপ্লবের, স্বপ্ন দেখেছিল নতুন কিছুর। কিন্তু রাষ্ট্র তাঁকে বাঁচতে দিল না। লাশকাটা ঘরে তাঁর মৃত শরীরের নম্বর ১০৮৪। সেই দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ব্রতীর মা, সুজাতা। ছেলের মৃত্যুতেও তিনি কঠিন, ছেলেকেও দিয়েছিলেন সেই কঠোরতার মন্ত্রবীজ। শুধু সুজাতা নন, সেই সঙ্গে উঠে আসে সত্তরের বাংলার আরও হাজার হাজার মায়ের মুখ। মহাশ্বেতা দেবীর কলম এভাবেই চিনিয়েছিল ‘হাজার চুরাশির মা’-কে, চিনিয়েছিলেন নিজেকেও। যেখানে একাকার হয়ে গেছে সাহিত্য, মানুষ এবং সংগ্রামের কাহিনি।

শুধু এই একটি মাত্র উপন্যাসই ব্যক্তি মহাশ্বেতাকে চেনায় না। তাঁকে চিনতে গেলে সাহিত্যের পাশাপাশি তাঁর জীবনকেও নিবিড়ভাবে দেখতে হয়। কর্মসূত্রে সমাজের সব ধরনের মানুষের সংগ্রামকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। রক্ত মাংসের সেই মানুষগুলোকেই তুলে ধরেছেন দুই মলাটে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “ধনীদের তৈরি দুর্ভিক্ষ, নিচু বর্গের মানুষকে উচ্ছেদ এবং অবর্ণনীয় অত্যাচার— এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আমার কাছে ধর্মবিশ্বাসের মতো।” নিঃসন্দেহে, মানুষই যে মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র ধর্ম ছিল…

কর্মী এবং লেখক— একসঙ্গে এই দুই সত্তাকেই বয়ে নিয়ে চলতেন তিনি। অবশ্য মহাশ্বেতার পরিবারের দিকে তাকালে এই পরিবেশেরই পরম্পরা দেখা যাবে। সে বাবা মনীশ ঘটক, কাকা ঋত্বিক ঘটকই হন বা পরবর্তীকালে স্বামী বিজন ভট্টাচার্য, ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্য— প্রতিবাদের আকর ছড়িয়ে ছিল সর্বত্র। সেখান থেকেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন মহাশ্বেতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর লেখা দৃষ্টিভঙ্গির বদলও এনেছিল।

একবার এক ঝাড়ুদার হঠাৎ করেই চলে আসেন মহাশ্বেতার কাছে। জানান, তাঁর মেয়ের বিয়েতে আচমকাই কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র উপস্থিত হয়েছিলেন। মেয়র নাকি বলেছিলেন, মহাশ্বেতা দেবীর বই পড়েই তিনি এই কাজ করেছেন। শুধু এইবার নয়, এরপর থেকে নিয়মিত এই অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকবেন তিনি! ঝাড়ুদারের মুখে শোনা এই কাহিনি মহাশ্বেতা নিজেই জানিয়েছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। অবশ্য কোন সময়ের ঘটনা, তখন কে ছিলেন কলকাতার মেয়র – তা অবশ্য বলে যাননি তিনি।

বদল বোধহয় এইভাবেই ছোট ছোট জায়গা থেকেই শুরু হয়। সেই ছোট জায়গার কাহিনিই তো বারবার বলতে চেয়েছেন মহাশ্বেতা! সমাজের একটা বড় অথচ অবহেলিত অংশের জীবন ও ইতিহাসকে উপেক্ষা করে যে কোনও শিল্পসাহিত্য হতে পারে না— সেই কথাই আজীবন মনে করে গেছেন তিনি।

সত্যিকে সত্যি হিসেবে দেখার, বলার অভ্যাস তাঁর গড়ে উঠেছিল ছোট থেকেই। পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে। তখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে। একদিন বছর দশেকের ছোট্ট মহাশ্বেতা তো বলেই বসলেন- “তুমি অত বই লিখো না।” অবাক হয়ে রবীন্দ্রনাথ কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাতে মহাশ্বেতার সপাট উত্তর- “আমার বাবা সব তোমার বই কেনেন আর কেনেন। অত অত বই আমি পড়তে পারি না।” তারপর সারাজীবন মনের মধ্যে ধরে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর সৃষ্টিকে।

আরও পড়ুন
কবিতা কি বাবার লিখে দেওয়া নাকি মায়ের নকল - 'বুনো' নবনীতা ও উত্তরাধিকারের গল্প

আজকের এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তবে কি আবারও কলম তুলে নিতেন না? দেখিয়ে দিতেন না রাস্তায় নামার পথ? ‘হাজার চুরাশির মা’ থেকে পরে আরও অনেকের ‘মা’ হয়ে উঠেছিলেন যিনি, যার গর্ভপুত্র একদিন লিখেছিলেন ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’; তিনি কি আজ সেই প্রতিরোধের মন্ত্র দিতেন না? মহাশ্বেতা নেই, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি আছে। একইভাবে, তীব্র হয়ে। সেসব আঁকড়ে ধরে, সত্যি কথাগুলো সপাটে বলতে পারব না আমরা?

ঋণস্বীকার-
১) কালি ও কলম, মহাশ্বেতা দেবীর সাক্ষাৎকার, বদরুন নাহার
২) প্রথম আলো, মহাশ্বেতা দেবীর সাক্ষাৎকার, নাসির আলি মামুন

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রয়াত শবরদের দিনবদলের পথিকৃৎ নন্দলাল শবর, শোকস্তব্ধ পুরুলিয়া