পরাজিতদের আর কে মনে রাখে? উচ্ছ্বাস আর উন্মাদনা তো শুধু জয়ীদের জন্য বরাদ্দ। জীবনের যুদ্ধে হারতে হারতে মনে হতেই পারে এরকম কথা। ঠিক তখনই যেন নতুন আশ্বাসবাণী নিয়ে আসতে পারে হারু উরারা (Haru Urara)। মানুষ নয়, ঘোড়া। জীবনের প্রতিটি রেস হেরেছে সে, তবু জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘোড়ার নাম হারু উরারা। জেতা বা হারার জন্য নয়, তার খ্যাতি প্রতিবার লড়াইয়ের ময়দানে নামার জন্য।
জাপানি ভাষায় ‘হারু উরারা’ শব্দের অর্থ ‘অপরূপ বসন্ত’। স্ত্রী প্রজাতির এই ঘোড়াটির জন্ম ১৯৯৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। তার পারিবারিক ইতিহাসে অনেকেই রেসের ঘোড়া হিসেবে সাফল্য পেয়েছে। তাই নোবুতা বোকুজোর ফার্মে সেভাবেই প্রস্তুতি দেওয়া হতে থাকে উরারাকে। ১৯৯৮-এর ১৭ নভেম্বর তার অভিষেক ঘটে রেসের ময়দানে। সেদিনই বোধহয় তার ভবিষ্যতের দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হয়ে যায়। পাঁচজনের লড়াইয়ে সবার শেষে থাকে উরারার নাম। মালিকপক্ষ অবশ্য তখনই হাল ছাড়েনি। পরের চার বছরে প্রতি মাসে একটি-দুটি দৌড়ে অংশগ্রহণ করে উরারা। আর প্রত্যেকটিতেই ফলাফল প্রায় একই। যদিও-বা ব্যতিক্রম কিছু ঘটে, সেটাও শেষের দিক থেকেই।
এভাবেই চলে এল ২০০৩ সাল। এর মধ্যে ৮০টি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে সে, কিন্তু জয়লাভ করেনি একটিতেও। আর সেই সূত্রেই উরারার গল্প চোখে পড়ে জাপানি সংবাদমাধ্যমের। একটি ঘোড়া গত পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত হারছে, তারপরেও ক্ষীণ আশা নিয়ে নামে প্রতিযোগিতায়। কোথাও গিয়ে জাপানের তৎকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে জুড়ে যায় হারু উরারার নাম। গত শতকের নয়ের দশকে ভয়ানক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জাপানের অর্থনীতি। যাকে বলা হয় ‘লস্ট ডেকেডস’ (Lost Decades)। একুশ শতকের শুরুতে সাময়িকভাবে ঘুরে দাঁড়ালেও, সম্পূর্ণ স্থিতিশীল হয়নি অবস্থা। হারু উরারা হয়ে উঠল সেই বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। তাকে ডাকা হতে থাকে ‘মেকেগুমি নো হোশি’ বলে। যার অর্থ ‘সর্বত্র পরাজিতদের উজ্জ্বল নক্ষত্র’। শুধু জাপানে নয়, আমেরিকা, কানাডাতেও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ঘোড়াটির নাম।
আরেকটি কাজেও ব্যবহৃত হতে থাকে হারু উরারার খ্যাতি। তার ধীরগতিকে কাজে লাগানো হয় পথ দুর্ঘটনা বিরোধী প্রচারে। এমনকি ছোটো ছোটো স্মারক বিক্রি হতে থাকে তার নামে। অনেকেই বিশ্বাস করতেন, এই স্মারক গাড়িতে রাখলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যায়। ঠিক যেভাবে কমতে থাকে উরারার দৌড় প্রতিযোগিতা জেতার সম্ভাবনা। এবার জাপানের সে সময়ের বিখ্যাত ‘জকি’ ইউতাকা তাকে নামেন আসরে। তিনি স্বেচ্ছায় নেন উরারার দায়িত্ব। ২০০৪ সালের ২২ মার্চ আরেকটি দৌড়ে অংশগ্রহণ করে সে। সবাই জানত, জেতার কোনো সুযোগই নেই তার। তবু উরারাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বহু মানুষ বাজি ধরে তার উপরে। সেদিন মাঠে ছিল ১৩০০০ দর্শক। ভিড় এতটাই বাড়তে থাকে যে আধ ঘণ্টা আগে খুলে দিতে হয় রেসের মাঠের দরজা। না, অলৌকিক কিছু ঘটেনি। এবারও হেরে যায় উরারা, টানা ১০৬তম রেসে। ১১টি ঘোড়ার প্রতিযোগিতায় শেষ করে দশম স্থানে।
আরও পড়ুন
অঙ্ক করতে পারত যে ‘চতুর’ ঘোড়া!
এই ফলাফল সকলের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। তবু সবাই তাকে দেখতে চেয়েছিল লড়াই করতে। হারুক বা জিতুক, সেটা মূল বিষয় নয়। উরারা চেষ্টা করছে। জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মন্তব্য করেন এ বিষয়ে, “আমি অন্তত একবার হারু উরারাকে জয়ী দেখতে চাই। বারবার পরাজিত হওয়ার পরেও হাল না ছাড়া মনোভাবের আদর্শ উদাহরণ এই ঘোড়াটি।” কারোর মনস্কামনাই পূরণ করতে পারেনি সে। ২০০৪ সালে উরারা যখন অবসর নেয়, তখন তার নামের পাশে ১১৩টি হার, জয়ের সংখ্যা শূন্য!
আরও পড়ুন
পর পর সাজানো একের পর এক ঘোড়ার কঙ্কাল, কোথায় রয়েছে এই সমাধি?
পরিসংখ্যান নিয়ে মাথা ঘামায়নি কেউ। ততদিনে তার অবয়বের ছোটো ছোটো পুতুল, খেলনা বিক্রি হতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে সতেজ হয়ে ওঠে জাপানের অর্থনীতিও। একটি ঘোড়া ছিল চরম দুর্দিনে তাদের সবচেয়ে বড়ো আশার জায়গা। বারবার ব্যর্থ হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। সে হেরে গিয়েও জিতিয়ে দিয়ে গেছে দেশের মানুষকে।
Powered by Froala Editor