‘এক থেকে দশের মধ্যে একটা সংখ্যা বলতে বললে বেশির ভাগ লোকে বলবে সাত, এক থেকে পাঁচের মধ্যে হলে তিন, আর ফুলের নাম বললে গোলাপ’। তোপসেকে বলেছিল ফেলুদা। সেরকমই, রবীন্দ্রসঙ্গীত বাদ দিয়ে বাংলা ও বাঙালির জনপ্রিয় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত একটা ‘আইকনিক’ গান বা সুর বেছে নিতে বললে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রিল্যুড, ‘গাঁয়ের বধূ’র পাশাপাশি উঠে আসবে ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’ বা ফেলুদার থিম মিউজিক। অথচ চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ, লেখক সত্যজিৎ-এর ঔজ্জ্বল্যের আড়ালে প্রায় ঢাকাই পড়ে থাকেন সঙ্গীতকার সত্যজিৎ।
‘পথের পাঁচালী’র আগে, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা ছবিতে আবহসঙ্গীত নিয়ে সেরকম ভাবনাচিন্তা করা হয়নি। কোনো অর্কেস্ট্রার দলকে ডেকে যা হোক একটা সূচনাসঙ্গীত, আর ভেতরে আবেগের দৃশ্যে একটু করুণ সুরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দিলেই কাজ সারা হয়ে যেত। সত্যজিৎ নিয়ে এলেন সম্পূর্ণ আলাদা এক ঘরানা। চলচ্চিত্রের নিজস্ব যে ভাষা, তার সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করেই আবহসঙ্গীত রচনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন; ব্যবহার করলেন ভারত তথা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খ্যাতি সম্পন্ন সঙ্গীতশিল্পীদের। অপু ত্রয়ী এবং ‘পরশ পাথর’এর জন্য পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ‘জলসাঘর’-এর জন্য বিলায়েৎ খাঁ সাহেব, ‘দেবী’তে আলি আকবর খাঁ।
‘তিন কন্যা’ থেকে আবহসঙ্গীতের দায়িত্ব নিলেন সত্যজিৎ নিজে। তাঁর নিজের কথায়—“এঁরা অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে থাকতেন, তাছাড়া আর একটা সমস্যা হত—এদের যদি ৩০ সেকেন্ড বা ২০ সেকেন্ডের পিস কম্পোজ করে বাজাতে বলতাম, ওঁরা সেটা ৩/৪ মিনিট বাজিয়ে ফেলতেন, ফলে আমাকে এডিটিং টেবিলে বসে ঘষেমেজে কেটেকুটে জুড়তে হত। এটা করতে করতে আমার মনে হ’ল, ফাইনালি যখন কাজটা আমিই করছি, তাহলে ওঁদের অপেক্ষায় না থেকে, আমিই আবহ সঙ্গীত রচনা করি!”
সত্যজিৎ বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষায় বদল আনলেন, সেই সঙ্গে আবহসঙ্গীতেও একটা নতুন দিকের সন্ধান দিলেন। তাঁর বেশির ভাগ ছবিতেই দেখা যায় থিম মিউজিকের প্রয়োগ — যা বিশেষ এক-একটি মুহূর্তকে উজ্জ্বল করে তোলে। যেমন ‘তিন কন্যা’র মণিহারা গল্পের চিত্রায়নে “বাজে করুণ সুরে ...” গানটির ব্যবহার বা ‘পোস্টমাস্টার’-এ সেই গ্রাম্য বৃদ্ধদের সঙ্গীত আসরের দৃশ্যটি। পুরনো দিনের গ্রাম্য কায়দায় কালোয়াতি, আর তার পশ্চাৎপটে ফুটে ওঠে শহর থেকে দূরে প্রায় নির্বাসিত, বেচারা পোস্টমাস্টারের অসহায় মুখ। দৃশ্যটি শুধু হাসায় না, ভাবিয়ে তোলে।
আরও পড়ুন
মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় ও একটি 'আকাশ কুসুম' বিতর্ক
‘সমাপ্তি’তে যখন অপূর্ব প্রেমে পড়েছে, তখন কোনো আবহসঙ্গীত বাজে না, কেবল সাবেকি আমলের কলের গানে শোনা যায় ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মনে...!’ আবার বৌ সেজে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে ওঠা মৃণ্ময়ী যখন তার পায়ের মল খুলে রাখে গ্রামোফোনের চোঙের মধ্যে, তার আগে রেকর্ডের ডিস্কটার ঘুরে যাবার শব্দ। কোনো গান ছাড়াই। তারপর মুক্তির উল্লাসে সে যখন ছাদ টপকে তার পোষা কাঠবিড়ালি চরকির কাছে ছুটে যায়, তখনকার দ্রুতলয়ের মিউজিক হঠাৎ থেমে যায় – দেখা যায় দূর থেকে রানার আসছে। তার ব্যক্তিগত ভাললাগা, ছেলেমানুষির রাজ্যে বাইরের লোকের পা পড়াতেই যেন আচমকা থেমে গেছে সুর। রানার চলে যাওয়া মাত্র মৃণ্ময়ী আবার নদীর ধারে রাখা রথের ওপর চড়ে চরকিকে আদর করে, আর দুলতে থাকে দোলনায়, যেন খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া পাখি। দৃশ্যের সঙ্গে মানানসই আবহসঙ্গীত দোলনার তালে তালে দর্শকের মনেও দোলা লাগিয়ে দেয়।
মনে পড়ে ‘চারুলতা’য় টাইটেল মিউজিক ‘মমচিত্তে নিতি নৃত্যে...’ বা বই খুঁজতে খুঁজতে চারুর কণ্ঠে সুর করে “বঙ্কিম, বঙ্কিম” – অসামান্য প্রয়োগ। চারু যখন অমলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গল্প লেখার চেষ্টা করে তখনকার আবহ সঙ্গীতে বিদেশি ছোঁয়া। অন্যদিকে চারু যখন তার গল্পের রসদ পায় দোলনায় বসে তার গ্রামের স্মৃতি থেকে—সেই সময়কার দৃশ্য পরিকল্পনা এবং সঙ্গীতের মেলবন্ধন একেবারে দেশি গাজন, চড়ক, সং যাত্রার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়, এবং তারপর কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা হয় ‘আমার গ্রাম’। পিয়ানোতে বসে “আমি চিনি গো চিনি তোমারে..” (কিশোর কুমারের গলায়) গানটির ব্যবহার দেওর-বৌদির হাসি তামাসার দৃশ্যটিকে আইকনিক করে তুলেছে। তাছাড়া, চারু আর অমলের ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে “ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে...” (বিজয়া রায়ের কণ্ঠে) বারবার ঘুরে ফিরে আসে।
আরও পড়ুন
শঙ্কু থেকে কিশোর গল্প, বারবার সেই অজানা দেশ ‘ডুংলুং ডো’ খুঁজেছেন সত্যজিৎ
একটা সময়ের পর দেখা যায় সত্যজিৎ বার্গম্যানের কায়দায় ‘পিয়োর মিউজিক’ থেকে সরে এসে আবহে সাউন্ড এফেক্ট বা ধ্বনির উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। যেমন, ‘কাঞ্চনঙ্ঘা’য় যেখানে রায়বাহাদুরের নির্বাচিত পাত্র মিঃ ব্যানার্জি কিছুতেই তাঁর কন্যা অর্থাৎ মণীষার সম্মতি পাচ্ছেন না—তখন পাহাড়ি পথে একদল খচ্চরের গলায় বাঁধা ঘণ্টার শব্দ -- বাজতে বাজতে এক সময় দূরে মিলিয়ে যায়। এরপর আর কোনো সংলাপ নিষ্প্রয়োজন। আবার যখন স্যুটশোভিত ব্যানার্জি মনীষাকে রাজি করাতে না পেরে তার জন্য আনা চকোলেট একটি ভিখিরি ছেলের হাতে দিয়ে দেন, চকোলেট পেয়ে ছেলেটি পরম আনন্দে নেপালি লোকসুর ভাঁজতে থাকে। আবার ছবির শেষে নিঃসঙ্গ রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ বার বার ডেকেও যখন কারও সাড়া পান না, তখন মেঘ সরিয়ে আস্তে আস্তে দেখা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া— আরও একবার ওই নেপালি লোকসুরটি শোনা যায়, তার সঙ্গে মেশে পাশ্চাত্য নোটস। শোনা যায় 'কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় কয়েকটা দৃশ্য শুটিং-এর সময় সাউন্ড রেকর্ডারে পাখির ডাক ধরা পড়ছিল না। সত্যজিৎ নিজে শিস দিয়ে ওই পাখির ডাক নকল করেছিলেন।
সাধারণত তাঁর ছবির গানে আমরা খুব বড়মাপের নেপথ্যশিল্পীর কণ্ঠ বা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার খুব বেশি দেখি না, কারণ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যখন খালি গলায় একটি চরিত্র গাইছে, তখন আবহে বাজনার প্রয়োগ বাস্তবসম্মত নয়। আবার ছবির স্বার্থে যখন দরকার পড়েছে তখন বেগম আখতার, সলামৎ আলিকে দিয়ে গান গাইয়েছেন ‘জলসাঘর’-এ। পেছনে বেজেছে খানদানি জমিদার বাড়িতে গান বাজনার উপযুক্ত বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গত। আবার শেষ দৃশ্যে যখন জলসাঘরের আলোগুলো নিভে যাচ্ছে, বিশ্বম্ভর বলছেন — “অনন্ত, সব নিভে গেল! নিভে গেল!” — তখন পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রেশনের ব্যবহার তাঁর বেদনাকে প্রকট করে তোলে। ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে বঙ্কিমি উপন্যাসের উপর তৈরি পুরনো বাংলা ছবির অনুষঙ্গে তাঁর লেখা এবং সুর দেওয়া গান — “ভালবাসার তুমি কি জানো” – শুনলে মনে হয় গানটি উনিশ শতকেরই। রামপ্রসাদী সুরে একটি স্বরচিত গান ব্যবহার করেছিলেন তিনি ‘দেবী’তে। ‘সোনার কেল্লা’তে ব্যবহার করেছেন রাজস্থানি লোকসুর, আবার ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ বেনারসি ঘরানার ভজন।
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ-এর ‘পিকু’ হয়তো সম্ভব হত না বার্গম্যানের একটি ছবি না দেখলে
সংগীতের ক্ষেত্রে একদিকে পশ্চিমের সুর - বাখ, বিঠোফেন, চায়কভস্কি মোৎসার্ট, আর অন্যদিকে ভারতীয় লোকসঙ্গীত এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূর্ছনায় বারবার তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। ‘পোস্টমাস্টার’-এর রতনকে তুলে ধরতে আবহে সারিন্দা এবং দোতারার মতো আটপৌরে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ মেজাজের গানকে বেহালায় রূপ দেওয়া হয়েছে। ‘ঘরে বাইরে’তে ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ বা ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ গানদুটির প্রয়োগও মনে পড়ে। 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' (এ পরবাসে রবে কে) আর 'জন অরণ্য' (ছায়া ঘনাইছে বনে বনে) ছবিতেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার ভোলার নয়। রবীন্দ্রনাথের মতই পাশ্চাত্যের অপেরা স্টাইল দেশীয় অনুষঙ্গে ব্যবহার করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র একটুখানি আর ‘বাক্স বদল’-এ ‘মায়ার খেলা’র কিছু অংশ তিনি ব্যবহার করেছিলেন।
সেই অপেরা স্টাইল এল ‘গু গা বা বা’ র গানে। আদ্যন্ত গানের ছবি। ‘ভূতের রাজা দিল বর’ গানটিতে গুপির খুলে যাওয়া গলার পাশাপাশি বাঘার একটু ভারি গলায়, ছড়া কাটার মত করে বলা কথাগুলো সেই অপেরা রীতির সার্থক উদাহরণ। ভোরের বেলায় গুপী বর পেয়ে গান গাইছে - ‘দেখোরে নয়ন মেলে ..’ গানটি ভৈরবী আশ্রিত। আবার ‘হীরকরাজার দেশে’তে ‘পায়ে পড়ি বাঘমামা’ গানে কর্নাটকী ঢঙে সুর, সেখানে ব্যবহার করেছেন দক্ষিণী বাদ্যযন্ত্র, বীণা, ঘটম ইত্যাদি। এ গানের শেষেও সেই অপেরা স্টাইলে ভয় আর মজার জমাটি মিশেল – ‘আর নিয়ে কাজ নাই/ এবারে চল পালাই/ বড় কষ্টে পাওয়া গেছে কেষ্ট/ যথেষ্ট, যথেষ্ট’। অমর পালের গাওয়া ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ গানে আবার পাই মরমিয়া লোকসঙ্গীতের মেজাজ।
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ ছাড়া কেউ বোঝেননি তাঁকে, অভিমান বুকে নিয়েই বিদায় ‘মন্দার বোস’-এর
বিশিষ্ট সঙ্গীত সমালোচকরা হয়তো শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং ওয়েস্টার্ন টিউনের প্রতি সত্যজিতের সমান আগ্রহ ও প্রয়োগ দক্ষতার দিকে বেশি গুরুত্ব দেবেন। কিন্তু সবশেষে বলতেই হয়, গুপি বাঘার গান যেমন করে তাঁর সঙ্গীতদর্শনের একটি বিশেষ দিক তুলে ধরে, তাকে বোধহয় ‘ছোটোদের জিনিস’ বলে সরিয়ে রাখা চলে না। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ঘরানার বড় বড় শিল্পীরা যা করতে পারলেন না, বাংলাদেশের ভবঘুরে দুই ছেলে সহজ সরল সুরে গেয়ে আর ঢোল বাজিয়ে সেই সব কালোয়াতিকে ছাপিয়ে গেল। এর জন্যই বলতে হয় ‘মহারাজা, তোমারে সেলাম।’
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
'পথের পাঁচালী'র সেটে আলাপ, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বললেন সৌমেন্দু রায়