নদীর ধারে মৃতপ্রায় বাবা-মা'কে রেখে আসত সন্তান, কলকাতা সাক্ষী ছিল এমন 'বর্বর' প্রথারও

গৌতম ঘোষের ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ সিনেমাটার কথা জানেন নিশ্চয়ই! শুধু সিনেমা বা কমলকুমারের গল্পে নয়, একটা সময় কলকাতা এবং তার আশপাশের ঘাটগুলোতেও দেখা যেত মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। প্রায় সেই সময়ই তৈরি হয়েছিল ঘাটের ধারের ছোটো ঘরগুলো। আজও গঙ্গার ঘাটগুলোতে গেলে দেখা যায় এসব।

গঙ্গা চিরকালই হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। সেটা কেবল পুজোআচ্চার সময় নয়, মৃত্যুর সময়ও। গঙ্গাপ্রাপ্তি না হলে যেন জীবন বৃথা। এই গঙ্গাপ্রাপ্তি নিয়ে একটি প্রচলিত গল্পও আছে। কোনো এক গঙ্গাহীন জায়গায় কলকাতার এক ছেলে এসে পৌঁছয়। সেখানে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। যখন খাবার সময় এল, তখন কোথা থেকে ঢাকঢোল নিয়ে হাজির হল লোকজন। শাশুড়িরও জেদ, আগে দুধ খেতেই হবে। কলকাতার সেই ছেলে দুধ খাওয়ার পর চারিদিক থেকে ঢাক বেজে উঠল। শাশুড়ি তাঁর জামাইকে আশীর্বাদ করে বললেন, “তুমি আজ পুত্রের কাজ করলে। এই তোমার পেটে গঙ্গাজল আছে, আর দুধের মধ্যে ছিল তোমার শ্বশুরের অস্থি গুঁড়ো করা। তোমার শ্বশুর অবশেষে গঙ্গা পেলেন!”

গল্পের শেষে কলকাতার সেই ছেলের অবস্থা কী হয়েছিল, জানা যায়নি। কিন্তু প্রায় এরকমই পরিস্থিতি ছিল হিন্দু সমাজে। আর এখান থেকেই অন্তর্জলি যাত্রার সূত্রপাত। হিন্দু সন্তানরা তাঁদের মৃতপ্রায় বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনকে গঙ্গার ধারে এনে রেখে দিত। কবে মৃত্যু হবে, সেটা তো আগে থেকে বোঝা যেত না। সেজন্য ঘাটেই একটি লোককে ভাড়া করে রেখে আসত তারা। গঙ্গার ধারে, খোলা আকাশের নিচে তাদের কষ্ট বাড়ত বই কমত না। এইভাবেই একসময় ‘গঙ্গাপ্রাপ্তি’ হত তাঁদের।

তখনও কলকাতা এবং তার আশেপাশের ঘাটগুলোয় কোনো ঘর ছিল না। ১৮২৫ সালে এই বিষয় নিয়েই লেখা বেরোয় ‘সমাচার দর্পণ’-এ। মৃত্যুকালে গঙ্গার ধারে মুমূর্ষু ব্যক্তিরা যে মাথার ওপর ছাদও পান না, সেই কথাই বলা হয় সেখানে। সেই প্রতিবেদন সাড়া ফেলে তৎকালীন বঙ্গ সমাজে। বলা ভালো, তারপরই গঙ্গার ঘাটের পাকা ঘরগুলি তৈরি শুরু হয়। শহরের বিত্তবান মানুষরাই এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যেমন, জানবাজারের বাবু রাজচন্দ্র দাস। স্ত্রী রানী রাসমণির অনুরোধে কলকাতায় তৈরি করেন নতুন একটি ঘাট, সেইসঙ্গে একটি পাকা ঘর। আজ যে জায়গা ‘বাবুঘাট’ নামে পরিচিত। এছাড়াও, বাকি ঘাটগুলোতেও তৈরি করা হয় এই ঘর।

আর এখানেই গঙ্গাপ্রাপ্তির অপেক্ষায় থাকতেন মুমূর্ষুরা। সারা গায়ে রাধাকৃষ্ণের চরণছাপ, নামাবলি, জপের মালা নিয়ে অন্তর্জলি যাত্রার অপেক্ষায় থাকতেন তাঁরা। আজ এই দৃশ্য দেখা যাবে না আর। কিন্তু সেই স্মৃতি নিয়ে গল্পকথার পাশাপাশি রয়ে গেছে গঙ্গার ঘাটের এই ঘরগুলো। আর রাধাকৃষ্ণের চরণছাপ।

তবে, যাবতীয় ইতিহাসের পরও, অমন প্রথা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। খুব কি দরকার ছিল অমনটি করার? বরং সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে হয়তো আরোগ্যলাভ করতেন বাবা-মা। কে জানে! বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। দিনে-দিনে বন্ধ হয়েছে সেই প্রথা। ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। ধর্মের দোহাই যতই দেওয়া হোক না কেন, আজকের আধুনিক দৃষ্টিতে সেটি যে একপ্রকার বর্বরতাই ছিল, তা নিয়ে বোধহয় নিঃসংশয় হওয়া যায়। কিছু প্রথা হারানোই ভালো...

তথ্যসূত্র—
‘কলির শহর কলকাতা’- হরিপদ ভৌমিক
চিত্র ঋণ -
পুরোনো কলকাতা ও দি গ্যাঞ্জেস ওয়াক

Powered by Froala Editor

More From Author See More