সন্ন্যাসীদের ভিড়, কাঁটার ওপর ঝাঁপ ও গ্রামবাংলার ‘হুজুগে গাজন’

কথায় বলে, বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণ। বছরের শুরু থেকে শেষ, গোটা সময় হরেক রকম উৎসবে মেতে ওঠে বাংলার পল্লী, গ্রাম ও শহর। শিবঠাকুরের আপন দেশে তাকে নিয়ে কিছু হবে না, তা কি হয়! চৈত্র মাস, বাংলা বছরের শেষ, আর শিব— সমস্ত কিছু একটি শব্দে এসেই শেষ হয়। গাজন। বঙ্গের অঙ্গে অঙ্গে যে উৎসব জড়িয়ে আছে প্রাচীন সময় থেকে। এবছর লকডাউন আর করোনার জন্য বন্ধ সমস্ত জমায়েত। এমন অবস্থায় গাজনের উৎসবও ঘোর অনিশ্চিত। একটি বছর একসঙ্গে জড়ো না হয় নাই হলাম। কিন্তু লেখার মাধ্যমে, গাজনকে সামান্য ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা চলতে থাকবে।

আসলে, গাজন হল শিবঠাকুরের বিয়েকে কেন্দ্র করে গ্রামবাংলার একটি অতিপ্রচলিত লোক উৎসব। ভিন্নমতে, বছর শুরুর প্রাক কালে শুভ ফলের উদ্দেশ্যেও পালিত হয় এই উৎসব। গ্রামের 'গা' আর জনসাধারণের 'জন' থেকেই 'গাজন' কথার আগমন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গাতেই গাজন অনুষ্ঠিত হয়। তবে তার মধ্যে রাঢ়ের বাঁকুড়া জেলা এই উৎসবের দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে।

হুগলির তারকেশ্বরের তারকনাথ শিব-সহ বাঁকুড়া এবং বর্ধমানের বেশকিছু গ্রামে চৈত্রমাসের সংক্রান্তিতে শিবের গাজন পালিত হয়। এই চৈত্র মাসই গাজন উৎসবের মূল সময় বলে পরিচিত। তবে আর্থিক, দৈবিক বা অজ্ঞাত কারণবশত বহুকাল ধরে চলে আসা নিয়ম মেনে বছরের অন্যান্য সময়েও কিছু জায়গায় 'হুজুগে গাজন' পালিত হয়।

যেমন, বাঁকুড়ার ইন্দাস থানার শাশপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ডোঙালন, নারায়ণপুর গ্রামগুলির উদ্যোগে বুনোশিবের আবির্ভাবতিথি হিসেবে বৈশাখ সংক্রান্তিতে গাজন পালিত হয়। অন্যদিকে, বাঁকুড়ার পত্রসায়র অঞ্চলের ভুতুরা সহ পার্শ্ববর্তী আরও কিছু গ্রামে এবং দুর্গাপুরের মলানদিঘি গ্রামেও বুদ্ধপূর্ণিমায় গাজন অনুষ্ঠিত হয়।

গাজন হয় অন্যসময়েও। বাঁকুড়া জেলারই ঝাঁটিপাহাড়ীতে প্রতিবছর এবং দ্বারকেশ্বর নদের কাছাকাছি যশদিঘি গ্রামে আশেপাশের আরও চার-পাঁচটি গ্রামের মিলিত প্রয়াসে কয়েক বছর অন্তর জ্যৈষ্ঠের সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় করুণাময় শিবের গাজন। এছাড়াও জ্যৈষ্ঠ মাসের দশহরাতে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে মনসার গাজন, মেদিনীপুরে বসন্তরায়ের গাজনও পরিচিত।

আবার বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে ধর্মঠাকুরের গাজন হয় আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায়। এছাড়াও হয় নীলের গাজন, ভগবতীর গাজন। কোনো কোনো গ্রামে বছরে একাধিক বার গাজনের দৃষ্টান্তও নাকি আছে!

তবে সময় আর গল্প ভিন্ন ভিন্ন হলেও গাজনের নিয়মগুলো কিন্তু প্রায় একই। তিনদিনের গাজনের প্রথমদিন রাতগাজন, দ্বিতীয়দিন দিনগাজন এবং শেষের দিন উতুরিখোলা (উত্তরীয় খুলে ফেলা) বলে পালিত হয়। তবে শুরুটা হয়ে যায় আরও তিনদিন আগে থেকে। একদিন নিরামিষ, পরেরদিন হবিষ্যি এবং রাতগাজনের আগের দিন ফল নিবেদন করা হয় উপাস্য দেবতার উদ্দেশ্যে। সন্ন্যাসীদেরও তাই গ্রহণ করতে হয় এ-সময়। সারাবছর ব্রাহ্মণদের দ্বারা পূজিত ঈশ্বর এই ক'দিন সর্বসাধারণের হয়ে ওঠেন। সমাজে উচ্চশ্রেণীরা নন; বাগদি-মুচি-হাঁড়ি-ডোম ইত্যাদি নিম্নবর্গের মানুষদেরই বেশিরভাগ গাজনের সন্ন্যাসী হতে দেখা যায়।

পরনে ধুতি এবং উত্তরীয় আর হাতে বেত নিয়ে গাজন চত্বরজুড়ে থাকে সন্ন্যাসীদের ভিড়। মন্দির প্রাঙ্গণে কাঁটার উপর ঝাঁপ দিয়ে, চড়ক গাছে চড়ে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বাণ ফুঁড়ে, বঁড়শি ফুঁড়ে, দু'পা উপরের দিকে বেঁধে নিচের জলন্ত আগুনে মাথা দুলিয়ে ইত্যাদি নানাপ্রকারে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতে হয় সন্ন্যাসীদের।

এতকিছুর পরও এই গাজনের মূল আকর্ষণ হল মেলা। প্রত্যেক জায়গাতেই গাজনকে কেন্দ্র করে ছোটো বা বড়ো একটা মেলা অবশ্যই বসে। নানারকম তেলেভাজা, বারোভাজা, জিলিপি, লবঙ্গলতিকার পাশাপাশি ইদানিং যোগ হয়েছে শহুরে ফুচকা, চাইনিজ, মোগলাইয়ের স্টল। এছাড়া থাকে নাগরদোলা, আলোর কায়দা, মণিহারি দোকান, লোহালক্করের দোকান, চিনেমাটি, পোড়ামাটির পসরা, ইলেকট্রনিক্স খেলনার দোকান, বাঁশ ও বেতের জিনিস, বেলুনওয়ালা, বাঁশিওয়ালা এবং হাতে মেহেন্দি আঁকা বা চাবির রিং-এ নাম লেখার স্টলও আজকাল গ্রামের মেলাগুলিকে সমৃদ্ধ করে তোলে।

শুরুতেই বলেছি, গাজন হল গ্রামের সাধারণ মানুষের উৎসব। আসলে যেন ঘুমিয়ে থাকা গ্রাম এভাবে জেগে ওঠে এই কদিনের জন্য। সাধারণ দিন আনি দিন খাইয়ের মুখে এভাবে জ্বলে ওঠে খুশির রোশনাই। সে আলোতে মুহূর্তের জন্য হলেও তখনকার মতো ম্লান হয়ে যায় শহরের ঝাড়বাতি। রাজপথ সেই দূর থেকে এসে খোঁজ নিয়ে যায় সেদিনের দামাল মেঠো হাওয়ার। কিন্তু ওই যে, প্রথমেই যা বলা হল। লকডাউনের পরিস্থিতিতে এই বছরের মতো গাজন অনিশ্চিত। রোগ যাতে আমাদের স্পর্শ করতে না পারে, তার জন্য একটি বছর তো কষ্ট করাই যায়। বরং, কিছু স্মৃতি আর অক্ষর নিয়েই গাজন পালিত হোক এখন। যাই হোক, উৎসব তো! সেটিও নতুন রূপ পাবে!

ছবিঋণ- রয়টার্স