আজ বাদে কাল আরও একটা নতুন বছর দিয়ে শুরু হবে আমাদের জীবন। আমাদের মানে, বাঙালির; বাংলার নববর্ষ বলে কথা! তবে পয়লা বৈশাখ আসার আগে আরও একটি উৎসব বাংলার গ্রাম-শহর ছুঁয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন— গাজন। বারো মাসে তেরো পার্বণের এই রাজ্যে গাজন পরবের মাহাত্ম্যই অন্যরকম! শহর কলকাতাতেও ছুঁয়ে গেছে সেসব…
পুরনো কলকাতার ইতিবৃত্ত নিয়ে যে সব লেখা আছে, প্রায় সব লেখাতেই চড়কের একটি দিক খুব তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে। সেটি যন্ত্রণার, বীভৎসতার। ভোর থাকতেই কালীপীঠে হাজির হত সন্ন্যাসীরা। তারপর গান গেয়ে, অভিনয় করে, নাচতে নাচতে শহর প্রদক্ষিণ করতে বেরোত তারা। রংবেরঙের পোশাক পরে রীতিমতো সং সেজে মিছিল বের করা হত। সেইসঙ্গে পিঠে, হাতে-পায়ে, জিভে বিঁধে থাকত সূচ, কাঁটা, লোহার শিক। এই ‘দৃশ্য’ চড়কের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেকোনো প্রকারে হোক, ‘বাবা তারকনাথ’-কে সন্তুষ্ট করা চাই-ই।
১৮২২ সালে কলকাতায় পা রাখেন ফ্রান্সেস স্যুজান আর্চার। তবে ‘ফ্যানি পার্কার’ নামেও বেশি পরিচিত তিনি। কলকাতা ঘুরে ঘুরে নিজের ডায়েরির পাতায় লিখে গেছিলেন; পরে সেটিই বই আকারে বের হয়। সেখানেই চড়কের জলজ্যান্ত বিবরণ লিখে গেছেন তিনি। তাঁর লেখা অনুযায়ী, “একদিন ঠিক করলাম (চৈত্র সংক্রান্তি) কালীঘাটে মন্দির ও জাগ্রত কালী দর্শন করতে যেতে হবে। চৌরঙ্গী থেকে মাইল দেড়েক দক্ষিণে কালীঘাটের কালীমন্দির। ঘোড়াগাড়ি করে কালীঘাট যাত্রা করলাম সন্ধ্যাবেলা। পথে এক দৃশ্য দেখলাম, উৎসবের দৃশ্য অবিস্মরণীয়। দেখলাম হাজার হাজার লোক রাস্তায় ভিড় করে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কীসের ভিড়’? শুনলাম, চড়ক পূজার উৎসব হচ্ছে। দীর্ঘ একটা কাষ্ঠদন্ডের মাথায় হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাওয়া চড়ক পূজার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কতরকমের লোক যে কত বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে তার ঠিক নেই। তার মধ্যে সর্বপ্রথম স্বচক্ষে দেখলাম এদেশের সাধুদের। সর্বাঙ্গে তাদের ভস্ম মাখা, মাথায় লম্বা লম্বা জটা, পরনে একটুকরো কাপড় জড়ানো, প্রায়-নগ্ন বলা চলে। একজন বৈরাগী তার শীর্ণ হাত দুটি মাথার উপর তুলে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে রয়েছে, অসাড় হয়ে গেছে হাত ও দেহ, পাখির মতন আঙুলের ধারালো লম্বা লম্বা নখগুলি হাতের পিছন থেকে বিঁধে ফুঁড়ে বেরিয়েছে ভিতরের তেলো দিয়ে। ভগবান বিষ্ণুর কাছে মানতের জন্য সে এই ভয়ংকর ক্লেশ স্বীকার করছে। নখগুলি প্রথমে বিদ্ধ হবার যন্ত্রণা হয় নিশ্চয়, কিন্তু পরে হাত অসাড় হয়ে গেলে আর কোন যন্ত্রণা থাকে না। এই শ্রেণীর আত্মপীড়নদক্ষ সাধুকে সকলে খুব পুণ্যবান মনে করে, কারণ ভগবানের পরম প্রিয়পাত্র না হলে এরকম কষ্টস্বীকার করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেখলাম সকলে ভক্তি-গদগদচিত্তে তার সাধুত্বের তারিফ করছে খুব।”
প্রকৃতপক্ষে, তখনকার দিনের চড়ক বলতে এমনই দৃশ্য সব বর্ণনাতেই আসবে। কালীপ্রসন্ন সিংহের বর্ণনাতেও এমনই ছবি। সারা শরীরে বিঁধে থাকা কাঁটা, শিক; সেই সঙ্গে নেশা, গান, নাচ— সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যময় এই পার্বণ। তবে এমন ‘ভক্তি’র জন্য দুর্ঘটনা ঘটত হামেশাই। কেবল সাধারণই নয়, বাবু শ্রেণীর মানুষরা, জমিদাররাও প্রচুর টাকা ব্যয় করত এখানে। লক্ষ্য ছিল দুটি, পুণ্যি অর্জনের; এবং সমাজের বুকে নিজের নামটা যাতে জ্বলজ্বল করে সর্বক্ষণ! রাত হলেই বসত বাইজি নাচের আসর। ভক্তি পেরিয়ে আমোদটাই বড়ো হয়ে উঠত তখন। পত্র পত্রিকায়, বইয়ে, সভায় সর্বত্র চড়কের এমন অশ্লীলতা ও বীভৎসতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। ব্রিটিশ সমাজ তীব্র নিন্দা করে এর। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আসলে সামাজিক মিলনের জন্যই তো এই উৎসব! চড়ক গাছের নিচে জড়ো হওয়া, তারপর চড়কির পিঠে ঘুরতে ঘুরতে ‘দে পাক দে পাক’ শব্দ— চৈত্রের শেষ দিন এভাবেই কলকাতার আকাশ বাতাস মুখরিত থাকত এই আওয়াজে।
আরও পড়ুন
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নিজস্ব নববর্ষ ও বিচিত্র সব রেওয়াজ
‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ - এমন কথা মাঝেই মাঝেই ব্যবহার করি আমরা। প্রবাদে পরিণত হওয়া এই কথাটির বাস্তব ভিত্তিও ছিল। ১৮২৮ সালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক! গাজন উৎসবে প্রচুর সন্ন্যাসী সমাগম হয়েছিল সেই সময়। যথারীতি, রংচঙে কাপড় পড়ে, বাণ ফুঁড়ে তাঁরা ভিড় জমিয়েছেন। সেখানেই উপস্থিত ছিল আরও দুজন ব্যক্তি। বেশভূষা সন্ন্যাসীর মতো, কিন্তু আদতে তা নয়। এসব আত্মগোপনের উপায়। সন্ন্যাসী সেজে ওই দুইজন দলে ভিড়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য পুলিশের হাতে ঠিকই ধরা পড়েন তাঁরা। তাঁদেরকে কারাগারেও বন্দি করা হয়। কিন্তু অমুক বাবুর গাজনে দুই ভুয়ো সন্ন্যাসী ধরা পড়েছে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়ল সব জায়গায়। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট— কথাটি আক্ষরিকভাবে রূপ পেয়েছিল সেইদিন।
আরও পড়ুন
নববর্ষের খাতায় পদ্য লিখলেন শক্তিদা, মৃত্যুর ছায়া ফুটে উঠল শ্যামলদার কলমে
শুধু কালীঘাট নয়, ধীরে ধীরে শহরের অন্যান্য অংশেও গাজনের মেলা বসতে থাকে। বাগবাজার, এন্টালি, পরবর্তীতে বিডন স্ট্রিটে ছাতুবাবুর বাজার— সব জায়গায় চড়ক ও গাজন একটা অন্য রূপ নিয়ে হাজির হয়। তবে ১৮৬৫-তে আইন করে গাজনের বাণ ফোঁড়া, কাঁটায় ঝাঁপ দেওয়া ইত্যাদি বন্ধ করার পর, এই ভয়াবহতা একটু কমতে থাকে। আজ সেই রূপ বদলে গেছে অনেকটাই। শুধু রয়ে গেছে মেলাটা। আজও ছাতুবাবুর বাজারে চড়কের গাছ বসে, অনুষ্ঠিত হয় বিশাল উৎসব। অন্যান্য মেলার মতোই আয়োজন এর। বছর শেষের আগে সবাইকে নিয়ে আবারও মেতে ওঠে কলকাতা। পুরনো, নতুন, ইতিহাস, বর্তমান— সব একসঙ্গে এসে মিশে যায় এখানে। শরীরের ওপর কষ্ট দেওয়ার প্রথা এখনও আছে, কিন্তু ভক্তি কমেনি। শিব ঠাকুরের আপন দেশে যেমনই নিয়ম হোক, বছরের এই একটি দিন কলকাতার প্রাচীনত্বকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে সবাই।
আরও পড়ুন
সংক্রান্তির দিনে, ঋণে জর্জরিত চাষিদের বড়শিতে গেঁথে ঘোরানো হত চড়কের গাছে
এখন তো লকডাউন, করোনার জন্য সবাই ঘরবন্দি। মেলা বা জমায়েতের ওপরও সাময়িক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ছাতুবাবুর বাজারে সেই চেনা ভিড়টা হয়ত থাকবে না। কিন্তু ইতিহাস, স্মৃতি, কথা তো থাকবে! সময় ভালো হলে, আবারও একসঙ্গে আসবে সবাই, মনে মনে চলছে এমনই প্রার্থনা।
তথ্যসূত্র-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১৭, ‘সে কাল থেকে এ কাল, ঐতিহ্যে অমলিন বাংলার চড়ক’
২) নীলকণ্ঠ.ইন
৩) সেকালের সংবাদপত্রে কলকাতা, হরিপদ ভৌমিক সম্পাদিত
Powered by Froala Editor