ধরা যাক, একটা টাইম মেশিনে চড়ে সোজা পিছিয়ে গেলেন আধখানা শতাব্দী। স্পষ্ট করে বললে ঠিক ৫২টি বছর। সেই কলকাতায় এত যানজট নেই, দূষণ নেই। রাস্তায় রাস্তায় সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, ব্রিফকেশ হাতে গম্ভীর চাকুরে, শাড়ি, লাল-নীল রিবনে বাঁধা চুল আর মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ঘোড়সওয়ার নেতাজির মূর্তি তখনো মাথা তোলেনি। আরো অনেক অনেক কিছুর মতোই তৈরি হয়নি ভিআইপি রোডও। সেই চত্বরে বিছিয়ে খাল, নয়ানজুলি, ঝোপ, অগাধ গাছপালা। বলা ভালো ছোটোখাটো জঙ্গল। আর, এরই একপাশে মাঠের পর মাঠ, জলাভূমি, গাছগাছালি, শেয়ালের ডাক আর সামান্য জনবসতি নিয়ে অপেক্ষা করছে একটা অঞ্চল। যেন অপেক্ষা করছে ঘুম থেকে জেগে ওঠার জন্য। দমদম পার্ক।
এই টাইমমেশিনই যদি আপনাকে ৫২ বছর আগেকার শরৎকালে পৌঁছে দেয়, তাহলে এই দমদম পার্কের ঘুম থেকে জেগে ওঠার তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধা হবে না। দেখবেন একটা পুকুরের পাশে ছোটোখাটো মণ্ডপ। প্রাণ পাচ্ছে গোটা এলাকাই।
এক অর্থে বলা যেতে পারে, একটি বারোয়ারি দুর্গাপুজোই একটি অঞ্চলের বদলে যাওয়ার নেপথ্য নায়ক। কিন্তু, দুর্গাপুজো না বলে যদি বলা যায় বারোয়ারির উদ্যোক্তাদের হাতেই দানা বাঁধতে শুরু করেছিল বদলে যাওয়ার আখ্যান, তাহলে বোধহয় ভুল বলা হবে না। মানুষের উৎসবের ইচ্ছে থেকেই দুর্গাপুজোর এই আয়োজন। ভালো থাকার ইচ্ছে। একসঙ্গে আনন্দ করার ইচ্ছে। এই সাবেক অনুভূতি থেকেই জন্ম নিয়েছিল চার নম্বর ট্যাঙ্ক যুবক বৃন্দের প্রথম দুর্গাপুজো।
ষাটের দশক। কালীমন্দিরের সঙ্গে ছোট করে দুর্গাপুজো হত তখন। খুব একটা জাঁক নেই বললেই চলে। যেন নিয়মরক্ষা। আদতে সর্বজনীন হলেও, ইতিহাস মেলাতে গেলে প্রথম বারোয়ারি পুজো ওটাই। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? কলকাতায় ততদিনে দুর্গাপুজোর বেশ নামডাক। হোক প্রত্যন্ত, দমদম পার্কও পিছিয়ে থাকবে না। এগিয়ে এলেন ধীরেন দে, বিনোদ সাহা, কালীনারায়ণ চৌধুরী, শ্রীধর মণ্ডল, দিলীপ রায়, কেশব মুখোপাধ্যায়, বি এল চক্রবর্তী প্রমুখ। সেটা ১৯৬৭ সাল। শুরুতে পুজোর নাম ছিল ৪ নম্বর ট্যাঙ্ক যুবক বৃন্দের পুজো। পরে নামের থেকে '৪ নম্বর ট্যাঙ্ক' শব্দবন্ধ খসে গেল। পুজোও সরে এল একটা খেলার মাঠে। বহরে বড়ো হল। জনস্রোতের ঢল বাড়তে লাগল ফি বছর। ধীরে ধীরে আমূল বদলে গেল গোটা দমদম পার্কটাই। এই বদলের ইতিহাস যদি লেখেন কেউ, তাহলে তিনি হয়তো শুরু করবেন পুকুর পাড়ে শুরু হওয়া ওই বারোয়ারি পুজো দিয়েই।
থিমপুজোর শুরু ২০০০ সালে। সেবারের পুজোর থিম ছিল একটি রাজবাড়ি। তারপর ধীরে ধীরে খ্যাতি পেল সেই পুজো। ক্লাবের এক সদস্যই সেই পুজোর থিমগুলি তৈরি করতেন। ২০০৮ থেকে বাইরে থেকে শিল্পী এনে শুরু হল থিম চর্চা। পরিমল পাল, ভবতোষ সূতার প্রমুখ শিল্পীর সৃষ্টিতে বিভিন্ন সময় সেজে উঠেছে যুবক বৃন্দের পুজো।
স্থানীয়রাও এই যুবক বৃন্দের পুজো নিয়ে গর্বিত। বিচ্ছিন্নতাবোধ নয়, একসঙ্গে সবাইকে নিয়েই এগিয়ে চলেছে যুবক বৃন্দ ক্লাব। ভেদাভেদ নেই ধর্মেরও। তাই সহজেই কোনো মুসলিম বা শিখ অধিবাসী একাত্ম হয়ে যান পুজোর সঙ্গে। নিছক ধর্মাচরণ নয়, উৎসবের অংশীদার হয়ে ওঠেন সবাই। এই যে সমন্বয়ের মেজাজ, এও কি বৈশিষ্ট্য নয় ক্লাবটির?
প্রতিদিন জনবিন্যাস বদলাচ্ছে। আসছে নতুন লোক। প্রতিটা লোকই কিন্তু খুব দ্রুত এই অঞ্চলের আপন হয়ে ওঠেন, দুর্গাপুজোয় তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। একটি পুজো কীভাবে যেন নবাগত বাসিন্দাদেরও কাছে টেনে নেয়। এটাই তো উৎসবের ম্যাজিক!
আর, শুধুমাত্র পুজোর জন্য পুজো নয় কিন্তু। পুজো যেন একটি সামাজিক বার্তা দেওয়ারও চেষ্টা করে। যে-কারণে ‘জল ধরো জল ভরো’ ছিল গতবছরের থিম। তাঁরা মনে করেন, পুজোর জনসমাগমের সুযোগে সমাজ সচেতনতাও ছড়ানো যেতে পারে। যাতে আখেরে উপকার হবে মানুষেরই। অন্যদিকে, সারাবছর জুড়েই পালিত হয় কোনো-না-কোনো অনুষ্ঠান। হেলথ চেক আপ ক্যাম্প, ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প, কম্বল বিতরণ, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, বৃক্ষরোপণ – এসবও ধরে রেখেছে এলাকার স্পন্দন।
এখন কলকাতার পুজোকে রীতিমতো টেক্কা দেয় দমদম পার্ক। তরুণ সংঘ, ভারতচক্র, তরুণ দলের পুজোগুলিও এই এলাকার বড় পুজো। পুজোর সময় লক্ষাধিক মানুষের ঢল নামে। সেই জনস্রোত কখনও বয়ে যায় শ্রীভূমির দিকে, কখনও পাক খায় দমদম পার্কেই। দুর্গাপুজোকে ঘিরেই গোটা দমদম পার্ক যেন নতুন চেহারা পায়। আর নতুন চেহারাতেও সেদিনের সেই ইতিহাস আওড়াতে থাকে সেদিনের সেই ক্লাব, কয়েকজন ‘পাগলে’র হাতে তৈরি করা যুবক বৃন্দের বারোয়ারির গল্প।
আজকের দমদম পার্কের পুজো বলতে শুধু যুবক বৃন্দ-কে বোঝায় না। কিন্তু ওই ক্লাবের পুজো কমিটির সেক্রেটারি রানা সেনগুপ্ত বলছিলেন, ‘তরুণ সংঘ, ভারতচক্র কিংবা তরুণ দলের সঙ্গে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা আছে বটে, কিন্তু সেই পুজোগুলোও আসলে দমদম পার্কেরই পুজো। ওগুলো আমাদেরই পুজো। ভারতচক্র বা তরুণ সংঘ বা তরুণ দলে যখন ভিড় হয়, তাহলেও দমদম পার্কের নামটাই সামনে আসে।’
দমদম পার্ক এখন অনেক উন্নত। জল জমে না। ঝোপঝাড় নেই। অভিজাত এলাকা হিসেবে গড়ে উঠছে সে। আগের মতো খোলা মাঠ নেই। কিন্তু বড়ো বড়ো পুকুরগুলো এখনও রয়ে গেছে। যুবক বৃন্দের পুজো হইহই করে চলছে। বছর বছর বাড়ছে ভিড়ও। পুজো উপলক্ষে পাত পেড়ে খিচুড়ি খায় গোটা অঞ্চল। মহিলাদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। সব মিলিয়ে আজকের দমদম পার্কের উন্নয়ন, বদলে যাওয়া, নতুন করে গড়ে ওঠা – এই সবটার পিছনেই একটি ক্লাব, একটি বারোয়ারি ও কয়েকটি উৎসবপাগল মানুষের ভূমিকা কিন্তু ভোলার নয়। বিশ্বাস করা শক্ত হতে পারে। কিন্তু যাচাই করতে হলে আপনার টাইমমেশিন লাগবে। একটিবার চলে যেতে হবে ৫২ বছর আগেকার দমদম পার্কে। তারপর সেই টাইমমেশিনে চেপেই ধাপে ধাপে পিছিয়ে আসতে থাকুন সাম্প্রতিকের দিকে। উত্তরটা সেখানেই পেয়ে যাবেন।
আর যদি টাইমমেশিন হাতের কাছে না থাকে, তাহলে আমাদের কথা বিশ্বাস না করে আপনার উপায় নেই!