উডি অ্যালেন-এর ছবি ‘মিডনাইট ইন প্যারিস’ মনে আছে? ওখানেই রসিকতা ক’রে বলা একটা সংলাপ ছিল, ‘পুরোনো দিনের সেই কবির মতোই অকালে মারা যেতে পারেন এই প্যারিসে, পাবেন না কেবল চিলেকোঠার জীর্ণ ঘর আর মারণ রোগ!’
ঠাট্টা হলেও কথাটা কিন্তু মিথ্যে ছিল না! প্যারিস – অর্থাৎ ছবির দেশ, কবিতার দেশ। শিল্পীদের তীর্থ, আড্ডাখানা, মাথা-গোঁজবার জায়গা। একই সঙ্গে রক্তাপ্লুত অনেকগুলি মৃত্যুর সাক্ষী।
কবি জেরার দু নের্ভাল সম্পর্কে শার্ল বোদলেয়ার বলেছিলেন, ‘নিজের আত্মাকে ইনি মুক্তি দিয়েছেন প্যারিসের সবচেয়ে অন্ধকার রাস্তায়।’ বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা ক’রে আগে ব্যর্থ হয়েছেন নের্ভাল। ১৮৫৫ সালের ২৬ জানুয়ারির রাতে ঢুকে পড়েন ‘রু দে লা ভিল লান্তার্ন’ নামে একটি অখ্যাত সরু গলিতে। ফাঁকা পানশালার জানলায় ঝুলে প’ড়ে নিজেকে শেষ করেন উন্মাদ কবি।
চিরকুটে আত্মীয়ার জন্যে লিখে গেছিলেন, ‘আমার জন্যে সন্ধ্যাবেলা বসে থেকো না, কেননা আজ রাত্তিরটা সাদা-কালো হয়ে যাবে!’
বিশ্বখ্যাত ‘লে ফ্লুর দু মাল’ বইয়ের ভূমিকায় বোদলেয়ার লিখছেন, ‘‘নোংরামির মধ্যে ডুবে আছে আমাদের ফ্রান্স আর প্যারিস হচ্ছে সার্বভৌম মূর্খামির তীর্থ।” যাপনের দিক দিয়ে কবি ছিলেন বোহেমিয়ান ‘ফুলবাবু’ (যাকে ডাকা হত ‘ড্যান্ডি’ নামে)। আফিমের নেশা ছিল তুঙ্গ, দুর্দশায় থেকেছেন দিনের পর দিন। দু বছর ভুগেছেন নিরাময়-অযোগ্য পক্ষাঘাতে। মারা যান ছেচল্লিশ বছর বয়সে, ১৮৬৭ সালে। প্যারিসেই, নিজের বাসায়। কবির মা তখনও জীবিত।
‘মূর্খ’ ও ‘নোংরা’ শহরকে নিয়ে তাঁর আবেগের অবিস্মরণীয় নজির ‘প্যারিস স্প্লিন’ বেরিয়েছিল মৃত্যুর দু বছর পরে।
বা ধরা যাক ইসিদোর লুসিয়েন ডুকাস-এর কথাই। ইনি জন্মেছিলেন লাতিন আমেরিকার উরুগুয়ে-তে। অল্প বয়সেই বাবার সঙ্গে চলে আসেন প্যারিসে। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ডুবে যান সাহিত্য পাঠে। …‘বাইরন, মিলটন, মুসে, বোদলেয়ার, এঁদের মতো বিষাক্ত লেখা আমিও লিখেছি’, প্রকাশককে চিঠিতে জানান তরুণ। লিখতেন ‘লোত্রেয়ামঁ’ ছদ্মনামে।
লেখা বাদে নিজের একটি স্মৃতিচিহ্নও যাতে ভবিষ্যতে না থাকে, সেদিকে ছিল নজর। ঘনঘন ঠিকানা বদলেছেন, দারুণ অভাবে গুজরান করেছেন দিন। শেষমেষ উঠেছিলেন ‘রু ফবুর্গ মমার্তে’ রাস্তার একটি হোটেলের ৭ নম্বর ঘরে। ১৮৭০ সালের ২৪শে নভেম্বর তারিখে এই হোটেলেই মারা যান কবি। নাম জানা যায় নি অসুখের, বলা হয় এক অজানা ‘জ্বর’। কোনো ডিটেলই পাওয়া না ডেথ সার্টিফিকেটে। মৃত্যুর সময় বয়স হয়েছিল মাত্র চব্বিশ।
রেখে গেছিলেন একটি মাত্র বই ‘লে চান্ট দে মালদোরোর’ (মালদোরোর-এর গান)। কেউই মনে রাখেনি সে-বইটির কথা।
১৯১৭ সালে প্যারিসের এক গলির দোকান থেকে বইটা খুঁজে পান সুররিয়ালিস্ট কবি ফিলিপ সুপো। সেই রাতেই পড়েন এবং পর দিন লেখক বন্ধু আন্দ্রে ব্রেতঁকে পড়তে দেন। ব্রেতঁ চমকে যান ‘মালদোরোর’ প’ড়ে। বইটি দ্রুত কাল্ট হয়ে ওঠে, আন্দ্রে জিদ বলেন ‘আর্তুর র্যাঁ বোর তুল্যমূল্য’, উচ্ছ্বাস জানান সালভাদোর দালি সহ অনেকেই। বিস্মৃত লোত্রেয়ামঁ-কে এ ভাবেই নতুন ক’রে ‘আবিষ্কার’ করে বিশ শতকের ইউরোপ।
আরেক জনের কথা বলি। ছোটো থেকেই ভুগতেন শ্বাসকষ্টে। যৌবনে প্যারিস জুড়ে অনেক হৈ-হল্লা করেছেন অভিজাত বাড়ির ছেলে মার্সেল। ‘ফুলবাবু’ বলেই তাঁকে চিনত লোকে। আস্তে আস্তে সেই জীবন থেকে সরে আসেন। অসুখ বাড়ছিল, ঘরবন্দি থাকতেন, লিখতেন আর সংশোধন করতেন অবিরাম। খাওয়াদাওয়ায় আনেন অনেক নিষেধ। উপোস ও শ্বাসকষ্টে জীর্ণ, হাড় জিরজিরে প্রুস্ত মারা যান একান্ন বছর বয়সে।
তখন ১৯২২ সাল। প্যারিস এই মৃত্যুটিও দেখেছে। তখনও শেষ হয়নি তাঁর সাত খণ্ডের উপন্যাস ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’-এর কাজ।
‘এক ঝড়বৃষ্টির দিনে প্যারিসে আমার মৃত্যু হবে,
যা মনে পড়ে…
যতদূর জানি দিনটা হচ্ছে বেস্পতিবার, ঋতুটা হচ্ছে শরৎ।’
‘সাদা পাথরের ওপর কালো পাথর’ নামে একটা কবিতায় আছে লাইনগুলো। লেখক হলেন পেরুর আভাঁ-গার্দ কবি সেজার ভায়েহো, যাকে তুলনা করা হয়েছিল মহাকবি দান্তে-র সঙ্গে। অতি আশ্চর্যের ঘটনা হল, ভায়েহো মারা গেছিলেন প্যারিসেই, অবিকল যেমনটি লিখেছিলেন তেমনই এক ঝড়বৃষ্টির রাতে!
না, দিনটা অবশ্য ছিল শুক্রবার, কবিতায় ছিল বৃহস্পতিবারের কথা। মাসটা ছিল এপ্রিল, তারিখ ১৫, সাল ১৯৩৮। নাম-না-জানা এক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে, পরে জানা গেছিল অসুখটা আসলে ম্যালেরিয়া। তখন বয়স হয়েছিল ছেচল্লিশ।
পাপ আর দুঃখের কথা ছাড়া শেষে কিছুই থাকে না, তবু দুঃস্বপ্নের শহর কী উজ্জ্বল রঙিন!