বাংলায় এসেছিলেন তাঁরা। ফিরে যেতে পারেননি আর। মারা গিয়েছিলেন এখানেই। সমাধিও দেওয়া হয়েছিল এখানেই। সারা বাংলায় পাওয়া যাবে এমন অনেক গোরস্থান। ইংরেজরা শুয়ে আছেন সেখানে। রয়েছে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষের গোরস্থানও। তেমনই এক গোরস্থান রয়েছে শ্রীমঙ্গলে। ‘ডিনস্টন সিমেট্রি’। এখন বাংলাদেশে। নীরব বনানী আর বন্যপ্রাণের মধ্যেই শতবর্ষের ইতিহাস বুকে নিয়ে শুয়ে আছেন ৪১ জন ইংরেজ। সঙ্গে আরও ৯ জন শিশু। আর সেই ইতিহাসের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন জেমস ফিনলে চা বাগানের কর্মচারীরা।
আরও পড়ুন
যেখানে ঘুমোচ্ছেন মধুসূদন, মৃতদেহে ছায়া দিচ্ছে পরী, কলকাতার হারানো অতীত ও এক কবরস্থান
উনিশ শতকের মাঝামাঝি। ব্রিটিশরা ভারতে নিয়ে এল এক নতুন ধরণের পানীয়। চা। যদিও তার আগেই হিমালয়ের কোলে শুরু হয়ে গিয়েছে চা চাষ। তবে মূলত বাঙালিদের সঙ্গে এই পানীয়ের যোগাযোগ ব্রিটিশদের হাতেই। চা চাষের জন্য নতুন নতুন জমিও খুঁজে বের করেছিল তারা। এভাবেই গড়ে ওঠে সিলেটের শ্রীমঙ্গল অঞ্চল। এখানে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ আরম্ভ হয় ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। তখন ছিল ডিনস্টন চা বাগান। পরবর্তীকালে বিক্রি হয়ে যায় জেমস ফিনলে টি কোম্পানির কাছে। চা বাগানের নাম থেকেই কবরস্থানের নাম ডিনস্টন সিমেট্রি।
আরও পড়ুন
সমাধিতেও তাঁর সঙ্গে শায়িত কৃষ্ণ-বিগ্রহ, এমনই গল্প কলকাতার চার্লস ‘হিন্দু’ স্টুয়ার্টের
বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ তখন সারা পৃথিবীতেই নতুন। বাংলায় তো বটেই। ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাই নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন। তাছাড়া, এদেশের শ্রমিকরা তো চা চাষের ব্যাপারে কিছু জানেই না। তাদের শিখিয়ে নিতেও হবে। নতুন এই শিল্পকে ঘিরে কিন্তু ইংরেজ শিল্পপতিদের ব্যাপক উৎসাহ ছিল। লাভের অঙ্কটা যে ভালোই। যাই হোক, বাংলায় চা শিল্পকে প্রতিষ্ঠা করতে ইংল্যান্ড থেকে এলেন প্রচুর কর্মচারী। আর শ্রীমঙ্গল অঞ্চলের প্রথম চা বাগানই তো ডিনস্টন চা বাগান। সেখানে ইংরেজ কর্মচারীর সংখ্যাটা তাই স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি ছিল।
আরও পড়ুন
শহরের প্রাচীনতম সমাধি হয়ে কলকাতায় শুয়ে আছেন রেজাবিবি
কর্মসূত্রে তো এলেন এদেশে, কিন্তু অনেকেই আর ফিরে যেতে পারলেন না। চা বাগানের মধ্যেই মৃত্যু হল অনেকের। ১৮৮৫ সালে মারা গেলেন রবার্ট রয়বেইল নামে এক কর্মচারী। রয়বেইলের বয়স তখন ৩৮। মৃতদেহ ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার খরচ প্রচুর। রয়বেইলকে তাই সমাহিত করা হল চা বাগানের মধ্যেই। সেই শুরু। ১৮৯৬ সালে জলে ডুবে মারা যান দুই শিশু উইলিয়ম জন ও ডেভিড সহাবি। তাদের সমাধিও আছে এখানেই। ১৯১৮ সালে মারা যান কর্মচারী জর্জ উইলিয়ম পিটারের স্ত্রী মেরি এলিজাবেথ পিটার। তাঁর মৃত্যুর এক বছরের মাথায় মারা যান জর্জ উইলিয়ম পিটারও। স্বামী-স্ত্রী এখানে একই কবরের নিচে শায়িত। এর মধ্যেই এসে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। শ্রীমঙ্গলের কাছেই ঘটল একটি দুর্ঘটনা। ১৯৩৯ সালে, আমেরিকার একটি যুদ্ধবিমান আকাশে ওড়ার আগেই ভেঙে পড়ল। প্রাণ হারালেন বিমানের পাইলট ও তাঁর সহযোগী। তাঁদের দুজনকেও সমাহিত করা হল এই কবরস্থানে।
আরও পড়ুন
ডাকাত ধরতে মেয়ে সাজতেন এই ইংরেজ পুলিশ অফিসার, শুয়ে আছেন কলকাতার বুকেই
এভাবেই একটু একটু করে বিস্তার পাচ্ছিল ডিনস্টন সিমেট্রি। এর মধ্যেই দেশভাগ। প্রথমে তৈরি হল পূর্ব-পাকিস্তান। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশ। ব্রিটিশরা চলে গেল দেশ ছেড়ে। কিন্তু সমাধিগুলো? তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। রয়ে গেল একটি ইতিহাস। বাংলায় চা চাষের ইতিহাস। আর সেই ব্যবসার সূত্রে গড়ে ওঠা দেশ-কাঁটাতারের সীমানাহীন একটি সম্পর্ক।
আরও পড়ুন
ঔরঙ্গজেব হত্যা করেছিলেন তাঁকে, মুঘল রাজপুত্র দারা শিকো-র ‘বিলুপ্ত’ সমাধির খোঁজ
এখনও এইসব স্মৃতির স্পর্শ পেতে ভিড় জমান অনেকেই। ৪৬টি কবরের ৫টিতে নেই কোনো নামের ফলক। তেমনই একটি কবরের উপর লেখা, ‘ইন লাভিং মেমোরি অব মাই হাজবেন্ড’। লিখেছেন জেসিজি নামের এক ইংরেজ মহিলা। স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে এসেছিলেন। তারপর আর তাঁদের দেখার সুযোগ হয়নি। সেই স্ত্রীর দুফোঁটা চোখের জলও হয়তো শুকিয়ে আছে পাথরের গায়ে। আর জমে আছে ১৪০ বছরের ইতিহাস।