পঞ্চাশের দশক। দেশ স্বাধীন হয়েছে সদ্য। কলকাতা শহরের ওপরই তখন জমজমাট ব্যবসা সার্কাস কোম্পানিগুলির। প্রিয়নাথ বোসের জমানার পর বাংলা তথা সারাদেশেই সার্কাস বেশ জনপ্রিয়। সে সময়ে বিশেষ কোনো খেলা যদি সার্কাস কোম্পানি প্রদর্শন করতে পারত, সেই দলকে নিয়ে হইচই পড়ে যেত। এমনই এক বিস্ময় হিসেবে উঠে আসেন রেবা রক্ষিত। ঐ রক্ষণশীল সমাজে তাঁর বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যেত পূর্ণবয়স্ক হাতি। তারপর দর্শকদের তুমুল করতালির মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চকে প্রণাম করতেন তিনি। কিন্তু কীভাবে এই অসীম ক্ষমতা রপ্ত করেছিলেন তিনি?
১৯৩০ সাল। অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায় জন্ম রেবার। ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে মেয়ের ব্যাপক আগ্রহ ছিল খেলাধুলো শরীরচর্চার উপর। গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, তালপুকুরের পাশের গ্রামের রাস্তা দিয়ে অবিরাম দৌড়ে বেড়ানো - এই ছিল রেবার জীবন। বাড়ির অন্য ভাইবোনদের খেলাধুলায় উৎসাহ না থাকলেও রেবা ছিলেন একেবারে অন্য ধাঁচের। স্কুলে পড়ার সময়েই কলকাতায় চলে আসে তাঁর পরিবার। কলকাতা এসে বাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও ভরতি হন এক যোগচর্চা কেন্দ্রে। তবে মায়ের সমর্থনেই রেবা বেশ কিছুটা ঝুঁকে পড়েন এই শরীরচর্চার খেলা দেখানোর দুনিয়ায়। এই যোগচর্চা কেন্দ্রটি ছিল ‘জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘ’। সে সময়ে শম্ভু মল্লিক ‘ব্যায়াম–চর্চা’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। উনিই ছিলেন জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘের কর্ণধার। তাঁদের সঙ্গেই একটু একটু করে নানা জায়গায় ক্যাম্পে যেতে শুরু করেন রেবা, এ-সময়ে রাইফেল চালানো শেখাতেও মন যায় তাঁর।
তার পর হঠাই এসে পড়া বিষ্টু ঘোষের আখড়ায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র এগারো। ঐ বয়সেয় রেবার শারীরিক সক্ষমতা দেখে চমকে যান বিষ্টুবাবু। সে সময়েই একটু একটু করে আসন আর যোগাভ্যাসের পাঠ তিনি দিতে শুরু করেন রেবাকে। তবে তখনও বুকে হাতি তোলার মতো ভয়ংকর খেলার কৌশল রপ্ত করেননি রেবা। এই কৃতিত্ব আরেকজন মানুষের যার নাম ব্যায়ামাচার্য বিষ্ণু চরণ ঘোষ। বিষ্ণুচরণ ঘোষের পেশি আর শ্বাস নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা থেকেই রেবা প্রথম এই পাঠের হদিশ পান। তবে রেবার হাতি তোলার অনেক আগে একবার প্রাথমিক ওজন বহনের পরীক্ষা হয়েছিল মোটরসাইকেলের খেলা দিয়ে। এই খেলা দেখানোর আগে বিশেষ প্রাণায়ামের জ্ঞান ও অর্জন করেন রেবা। ১৯৪৫ সালে প্রথম এক সার্কাসের ম্যাটিনি শো-তে বুকের ওপর মোটরসাইকেল চলে গেল রেবার। এই মোটরসাইকেলের খেল জনপ্রিয় হবার পরেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেলেন রেবা। কতই বা বয়স তখন? পনেরো কি ষোলো বড়োজোর। এ প্রসঙ্গে রেবা নিজে বলেছিলেন একটি রোমহর্ষক ঘটনা -
“মোটর সাইকেল চালাতেন বিষ্টুদার খুব প্রিয় ছাত্র প্রভাসদা। তাঁর মোটর সাইকেলটা ছিল বুইক গাড়ির মতো ভারি, চওড়া টায়ার। প্রভাসদাকেও বললাম, আজ একটা কিছু হবে। প্রভাসদা বললেন, আমি কিছু জানি না। তুই বিষ্টুদাকে বল। এই সব বলাবলি করছি, বিষ্টুদা বললেন, শুয়ে পড়। সোজা হয়ে শুয়েছি। দেখি, মাথায় একটা ইঁটমতো কী লাগছে, আমি মাথাটা কাত করে দিলাম। সমস্ত ‘শো’টা মুভি–তে ধরে রাখা হবে। বিষ্টুদা বললেন, মাথা ঘোরালি কেন? তোর মুখ দেখা যাবে না। ভাবলাম, কাজ নেই বাবা মুখ দেখিয়ে। ওয়েট যখন উঠবে, ঝাঁকুনিতে মাথা যদি তখন ফুটো হয়ে যায়। ভাগ্যিস, ছবি তোলার লোভে মাথা সোজা করিনি! মন বলছিল একটা কিছু হবে। অথবা হতেও পারে, ভয় পেয়েছিলাম। আমি তো শুয়ে সবই দেখতে পাচ্ছি। মোটর সাইকেল এল। প্রথম চাকাটা বেরিয়ে গেল। দ্বিতীয় চাকাটা একেবারে আমার মুখে এসে ধাক্কা দিল। আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। তাড়াতাড়ি আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। আর চিৎকার! প্যান্ডেল বোঝাই মানুষ তখন চিৎকার করছে। ভেবেছে নির্ঘাত মরে গেছি। জনতার দাবিতে কোনোরকমে স্টেজে নিয়ে আসা হল। মুখটা একেবারে কালো হয়ে গেছে। মুখের পাশে টায়ারের ছাপ। একেবারে যেন খোদাই–করা। সেই ছোপ উঠতে প্রায় দু–মাস লেগেছিল।”
আরও পড়ুন
রয়েছে মুদ্রার অন্য পিঠও, হাতিদের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে লড়াই চালাচ্ছেন কেরালারই মেয়ে সঙ্গীতা
এরপর শুরু হল হাতির খেলা যা রেবাকে প্রতিষ্ঠা দিল সর্বস্তরে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক থেকেই রেবা সার্কাসে হাতির খেলা দেখাতে শুরু করেন। জীবনের নব অধ্যায়ের সূচনা এখান থেকেই। রেবার শিক্ষা সম্পূর্ণ হলে শহরে তাঁবু ফেলা এক সার্কাসের মালিকের সঙ্গে কথা বলে শো’য়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন বিষ্টু বাবু। ট্রায়ালে ঠিক হয় পঞ্চাশ–ষাট মন ওজনের বাচ্চা হাতি রেবার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যাবে। ট্রায়ালে পাশ। অতএব ফাইনাল শো। বাড়ির সমস্ত বাধা ছুঁড়ে ফেলে মেয়ে চলে গেল বুকে হাতি তুলতে। চমক! বিশাল হাতি চলে গেল, নির্বিকার রইল মেয়ে। যেন কিছুই হয়নি।
আরও পড়ুন
১০৪ বছর আগেও 'বিনোদনে’র শিকার, প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল একটি মাদী হাতিকে
এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পরেই বিভিন্ন সার্কাস কোম্পানি থেকে ডাক আসা শুরু হল রেবা রক্ষিতের। তখনকার দিনে শো প্রতিদিন একশো টাকা থেকে একশো পঁচিশ টাকা। শনি আর রবিবার সেটাই হয়ে যেত ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২ টানা আট বছর ধরে গ্রেট বম্বে সার্কাসের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠলেন রেবা রক্ষিত। জিমন্যাস্টিক, যোগাসনের পাশাপাশি হাতির খেলা হয়ে উঠল দর্শকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বুকের ওপর পেতে দেওয়া হত কাঠের তক্তা, তার ওপর দিয়ে হেঁটে যেত সুবিশাল হাতি। দর্শকদের চোখ বুজে ফেলার রোমাঞ্চ নিয়েই ফের উঠে দাড়াতেন রেবা, যেন কিছুই হয়নি।
আরও পড়ুন
মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছে হাতি-বাঘ, বন্যজন্তুর ‘থ্রিডি’ হাজিরা সার্কাসে
এমন হল যে, একসময় হাতির খেলা না থাকলে তাঁবু ফাঁকা যেত। হাতির পায়ের চাপে যখন শরীরে পড়ত সেই চাপ যে কি জিনিস রেবাই জানতেন। চোখের কোনে রক্ত জমতে শুরু করেছিল। ডাক্তার স্পষ্ট বলে দিলেন হাতির খেলা বন্ধ। শেষবার গুরু ব্যায়ামাচার্য বুকের উপর কাঠের পাটাতন রেখে মাথার শির চেপে ধরলেন। হাতি হেঁটে গেল। আবারও চমক, চোখের লাল দাগ সেরে গেল। তবে আর সার্কাসে খেলা দেখাননি রেবা।
আরও পড়ুন
ভালো কাটুক শেষ জীবন, সার্কাস দলগুলির থেকে হাতি কিনে নিল ডেনমার্ক সরকার
রেবার কেরিয়ার শেষ হল ইন্টারন্যাশানাল সার্কাসের হয়ে। এই হাতি বুকে তোলার কৌশল রপ্ত করার জন্য তাঁকে ভারতসরকার সম্মানিত করেছিল পদ্মশ্রী পুরস্কারে। তবে রেবা রক্ষিত তাঁর বিখ্যাত হাতির খেলার জন্য সম্মানিত হলেও তাঁর যোগাসন, প্রাণায়ম আর শরীরচর্চার নিরলস অধ্যাবসায় তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কিংবদন্তি যাদুকর পিসি সরকারের সঙ্গে একই মঞ্চে আমন্ত্রিত হিসেবে খেলাও দেখিয়েছিলেন রেবা।
এক মারণ খেলা, যার সামান্যতম ভুল টলিয়ে দেবে আয়ুরেখা - সেই খেলার সম্রাজ্ঞী হয়ে থাকবেন রেবা রক্ষিত। যদিও সার্কাসের খেলাকে মূলস্রোতের খেলার স্বীকৃতি দেন না অনেকেই তবু এক মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের মেয়ে পঞ্চাশের দশকে বুকের ওপর হাতি তুলে ফের উঠে আসছেন মঞ্চে, কয়েক হাজার দর্শকের হাততালিতে মুখরিত হচ্ছে তাঁবু - এর চেয়ে রোমহর্ষক দৃশ্য হয়তো বাঙালি খুব কমই দেখেছে তাঁর ইতিহাসে...
ছবিঋণ - রমিত ব্যানার্জি
Powered by Froala Editor