প্রতিযোগিতা কি শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের হয়? যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের প্রতিযোগিতাও তো চলে। বাস্তব জীবনে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে প্রত্যহ। পুরনো প্রযুক্তিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে নতুন প্রযুক্তি। তবে মাঝে মাঝে এমন প্রতিযোগিতার আসরও বসে। ১৯১৩ সালে কলকাতা শহরেই বসেছিল এমন একটি আসর। বালিগঞ্জ স্টোর রোডে (বর্তমানে গুরুসদয় দত্ত রোড) প্রতিযোগিদের একপক্ষে ছিল গ্যাসবাতি আর অন্যদিকে বিজলিবাতি। এবং আশ্চর্যের বিষয়, সেবার কিন্তু বিচারকদের নিদানে বিজলিবাতির পরাজয় ঘটেছিল। উজ্জ্বলতার বিচারে এবং খরচের দিক থেকে, দুই দিকেই গ্যাসবাতিকে এগিয়ে রেখেছিলেন বিচারকরা। তবে সেদিন হয়তো অনেকেই আন্দাজ করেছিলেন, এই নতুন প্রযুক্তি খুব তাড়াতাড়ি পুরনোর স্থান দখল করতে চলেছে। কলকাতা শহরে শুরু হতে চলেছে একটি নতুন যুগ। বিদ্যুতের যুগ।
তবে বিজলিবাতির সঙ্গে কলকাতার পরিচয় ঘটেছে আগেই। ১৮৭৯ সালে কলকাতায় প্রথম বৈদ্যুতিক আলোর প্রদর্শনী করে পি ডব্লিউ ফ্লিউরি অ্যান্ড কোম্পানি। এর দুবছর পর ম্যাকিনন অ্যান্ড ম্যাকেঞ্জি কোম্পানি গার্ডেনরিচ সূতাকলে বৈদ্যুতিক আলোর কেরামতি দেখায়। ১৮৮৫ সালে চিৎপুরের এক ধনী ব্যক্তির আয়োজনে একটি শোভাযাত্রায় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা হয়। এই পুরো পরিকল্পনা তৈরি করেছিল 'দে শীল অ্যান্ড কোম্পানি'। এর ঠিক পরের বছর, ১৮৮৬ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনেও বৈদ্যুতিক আলোর বন্দোবস্ত ছিল। তবে এসবই ছোট ডায়ানামো ব্যবহার করে অল্প বিদ্যুতের উৎপাদন। গোটা কলকাতা শহরকে বিদ্যুতের সরবরাহ দেওয়ার মতো উদ্যোগ কিন্তু নিয়েছিল একটি ব্রিটিশ কোম্পানি। আর সেই কোম্পানিই নানা পটপরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে হয়ে উঠেছে কলকাতার একান্ত আপন 'ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন' বা সিইএসিসি।
ঘটনার সূত্রপাত ১৮৯৫ সালে। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় বাড়িতে বাড়িতে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছে। আর কলকাতা তখন ভারতের রাজধানী তো বটেই, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর। লন্ডনের পরেই তার স্থান। অতএব কলকাতা শহরেও বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিল ব্রিটিশ সরকার। সেই উদ্দেশ্যে কলকাতার মোট ৫৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২১ বছরের বরাত দিল সরকার। বরাত পেলেন লন্ডনের কিলবার্ন কোম্পানি। ১৮৯৭ সালে ১০০০ পাউন্ড মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করল ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানি লিমিটেড। আর একমাসের মধ্যেই কোম্পানির মূলধনও ফুলে উঠল। তবে তার জন্য বদলাতে হল নাম। কারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকেই যে বাঙালি। তাই নতুন নামকরণ করা হল ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন লিমিটেড। কিন্তু কোম্পানির কাজকর্ম চলত লন্ডন থেকেই।
১৮৯৮ সালে ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল এবং বেঙ্গল ক্লাবে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের পর ১৮৯৯ সালে স্থায়ী বৈদ্যুতিক লাইন পাতা হয়। প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু হয়। আর প্রথম বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা হয় হ্যারিসন রোড অর্থাৎ বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোডে। তবে কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। আর সেই কাজে বরাত জুটে যায় শুরুতেই। কিন্তু এই রাস্তাটা একেবারেই সহজ ছিল না। প্রথমত, কলকাতার সাধারণ মানুষের মনে তখনও গভীর ধর্মান্ধতা। আর বিদ্যুৎ জিনিসটাকে তাঁরা বেশ ভয় করেই চলতেন। তাছাড়া শুরুতে বিদ্যুতের দাম ছিল লন্ডনের সমান, অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে এক টাকা। ফলে প্রথমদিকে গ্রাহকের সংখ্যা ছিল বেশ কম। অবশ্য গ্রাহক বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কিছুদিনের মধ্যেই বিদ্যুতের দাম কমিয়ে অর্ধেক করে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরেও যে গ্যাসবাতির জায়গা দখল করতে পারেনি বৈদ্যুতিক বাতি, সেকথা আগেই বলেছি।
তবে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছিল অন্য কারণে। আলো জ্বালানোর কাজে নয়, বরং পাখা টানার কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে বাঙালি। তখন বড় মানুষদের বাড়িতে এক শ্রেণীর কর্মচারী রাখা হত, যাদের কাজ ছিল পাখার দড়ি টেনে হাওয়া করা। কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষদের সেই সামর্থ্য নেই। আবার বদমেজাজি বাবুরাও কর্মচারীর সামান্য ক্লান্তিতেই বিরক্ত হয়ে উঠতেন। এই সমস্যা সমাধান করেছিল বিদ্যুতের ব্যবহার। এমনকি চাহিদা এতটাই বেড়েছিল যে কোম্পানি একসময় দৈনিক চুক্তিতে বৈদ্যুতিক পাখা ভাড়া দিতেও শুরু করে।
আরেকটি জায়গায় বিদ্যুতের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সেটি হল ছোটো ছোটো কারখানা। ছাপাখানা বা সুতো কাটার কলের সামান্য শক্তির জন্য বড় বড় বয়লার ব্যবহার করা বেশ সমস্যাজনক। এইসমস্ত শিল্পের মালিকরা তাই তাড়াতাড়ি বিদ্যুতের সংযোগ নিতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। আবার এদিকে মাত্র এগারো মাসের পরীক্ষামূলক ব্যবহারে চারটি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাষ্পচালিত ট্রাম। আবার কলকাতার পাথুরে খোয়াইয়ের রাস্তায় ট্রাম টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ঘোড়ার দল। তাই ১৮৯৯ সালেই পরীক্ষামূলকভাবে বৈদ্যুতিক ট্রাম ব্যবহার করে কিলবার্ন কোম্পানি। আর ১৯০২ সাল থেকে ট্রাম চালানোর কাজে বিদ্যুতের ব্যবহারই প্রধান হয়ে ওঠে।
কলকাতায় বিদ্যুতের ইতিহাসে এরপর বড়ো ধরনের ঘটনা আর খুব বেশি ঘটেনি। ধীরে ধীরে কারখানা থেকে গেরস্থালি, সমস্ত ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়তে থাকে। এমনকি মফঃস্বলেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিদ্যুতের ব্যবহার। কিন্তু হুগলি নদী পেরিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ পৌঁছবে কী করে? এর সমাধান হল ১৯৩১ সালে। নদীর নিচ দিয়ে খোঁড়া হল একটি সুড়ঙ্গ পথ। আর সেই পথে বিদ্যুতের তার পৌঁছে গেল হাওড়ার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে। মেট্রো রেলের সুড়ঙ্গ যদি কলকাতার অনন্য ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নমুনা হয়, এই সুড়ঙ্গও তবে খুব পিছিয়ে থাকে না।
এভাবেই দেখতে দেখতে এসে গেল স্বাধীনতা। কিন্তু কলকাতার বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থার অফিস তখনও লন্ডনে। ১৯৭০ সালে দায়িত্বভার স্থানান্তরিত করা হয় কলকাতায়। অবশ্য তার ফল যে সবদিক থেকে খুব ভালো হয়েছিল, সেকথা বলা চলে না। কলকাতা শহরের নাম কিছুদিনের মধ্যে হয়ে দাঁড়ায় 'লোডশেডিং নগরী'। শহরের কোথাও কোথাও দিনে ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকত। এই সমস্যার সমাধান হয় ১৯৮৯ সালে। কলকাতায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্ব নিলেন রমাপ্রসাদ গোয়েঙ্কা বা আরপিজি কোম্পানি। বজবজ অঞ্চলে প্রথমে দুটি এবং পরে আরও একটি পাওয়ার গ্রিড বসানো হল। দেশের নানা প্রান্তের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির সঙ্গে চুক্তি তৈরি করা হল।
আর তারপর বিদ্যুৎ বাদ দিয়ে নাগরিক জীবন কল্পনা করাই কঠিন হয়ে উঠল। কিছুক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ না থাকলেই শহরবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। অথচ, এখন ভাবতেও অবাক লাগে, ১১১ বছর আগে এই কলকাতা শহরের মানুষই বিদ্যুতের পরিবর্তে গ্যাসবাতির পক্ষে রায় দিয়েছিল।
Powered by Froala Editor