হলুদ হয়ে যেত ত্বকের রং, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্ত্র তৈরির অভিশাপ ‘ক্যানারি গার্লস’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (First World War) গল্প এটি। ইউরোপের বিভিন্ন শহরে-গ্রামে, অরণ্যে-প্রান্তরে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ সৈন্য। দেশ থেকে প্রায় সমস্ত শক্তসামর্থ্য পুরুষ চলে গেছে যুদ্ধে। শত্রুসেনাকে হারিয়ে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে সমৃদ্ধির গৌরব। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে তাদের বীরত্বের গল্প। আর দেশে তখন কয়েক লক্ষ মহিলা নীরবে বানিয়ে চলেছে অস্ত্রশস্ত্র। বিষাক্ত সব রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে দিনের পর দিন কাটিয়ে শরীরে বাসা বেঁধেছিল অসুস্থতা। সম্পূর্ণ হলুদ হয়ে গেছিল অনেকের দেহ। ইতিহাস যাদের মনে রেখেছে ‘ক্যানারি গার্লস’ (Canary Girls) নামে।

এত বড়ো যুদ্ধ আগে দেখেনি বিশ্ববাসী। অস্ত্রের বিধ্বংসী ক্ষমতার নির্বিচারে প্রয়োগে যে মানুষ কত সহজে মানিয়ে নিতে পারে, তার প্রথম নমুনা পেশ করল ‘দ্য গ্রেট ওয়ার’ (The Great War)। আর ইংল্যান্ডকে ছাড়া গল্প এগোয় না কোনো যুদ্ধেরই। কিন্তু প্রথম থেকেই একটা সমস্যা বারবার ভুগিয়েছে তাদের। শিল্পনির্ভর সভ্যতা পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল কলকারখানার উপরে, যার মূল শ্রমিক ছিলেন পুরুষরাই। তারা যুদ্ধে যাওয়ায় বড়ো সংকট নেমে আসে যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুতিতে। যার পোশাকি নাম ছিল ‘শেল ক্রাইসেস অফ ১৯১৫’ (Shell Crises of 1915)। শত্রুপক্ষ এবং মিডিয়া দুদিক থেকেই একের পর বোমায় কেঁপে উঠছে ইংল্যান্ডের সম্মান। তড়িঘড়ি পাশ করা হয় ‘যুদ্ধাস্ত্র আইন’। যেখানে রাষ্ট্রের অধীনস্থ বেসরকারি সংস্থাগুলিকে অবাধ ছাড় দেওয়া হয় অস্ত্র বানানোর জন্য। সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয় কাজের, নিষিদ্ধ করা হয় ধর্মঘট। মালিকের অনুমতি ছাড়া কাজ ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত করে দেওয়া হয় দণ্ডনীয়। 

ইংল্যান্ডে মহিলা শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরেই যুক্ত ছিলেন কলকারখানার কাজে। এই সময়ে পুরুষদের অভাবে অস্ত্র নির্মাণের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে তাদের উপর। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে বোমা-বন্দুকের সামনে দাঁড়ানোর চেয়ে কোনো অংশে কম বিপজ্জনক নয় সেই কাজ। বাইরের আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে শত্রুপক্ষের বোমারু বিমান। কারখানাগুলি ছিল যাদের মূল লক্ষ্য। ঘরের মধ্যে রয়েছে অগুনতি বিপজ্জনক অস্ত্র আর তাদের ভিতরের শক্তিশালী বিস্ফোরক। চাপ সামান্য বেশি পড়লেই ফেটে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। এক গর্ভবতী মহিলার সঙ্গে ঘটেছিল সেরকম ঘটনা। প্রাণে বেঁচে গেলেও বিস্ফোরণে উড়ে যায় তার দুই হাত, নষ্ট হয়ে যায় দৃষ্টিশক্তি। 

বহু রকমের বিধিনিষেধ ছিল পোশাকেও। বিশেষত তড়িৎ পরিবাহী বলে নাইলন আর সিল্কের কাপড় ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রত্যেকদিন প্রবেশ-প্রস্থানের সময় তন্নতন্ন করে খোঁজা হত তাদের শরীরের প্রতিটি অংশ। নজর রাখা হত জীবনযাত্রার উপরেও। যদি কোনো গুপ্তচর ঢুকে পড়ে সেই দলে! এত সাবধানতা কিন্তু তাদের সুরক্ষার জন্য নয়, অস্ত্রদের নিরাপত্তার জন্য। যদিও তাতে এড়ানো যায়নি বড়োসড়ো দুর্ঘটনা। অন্তত তিনটে ভয়ানক বিস্ফোরণে মৃত্যু ঘটে কয়েকশো মহিলার, আহত হন এক হাজারেরও বেশি। তবে এগুলি নেহাত ‘দুর্ঘটনা’। বিস্ফোরক পদার্থ নিয়ে কাজ করতে হলে এটুকু আশঙ্কা তো থেকেই যায়। যাকে বলে— ‘প্রফেশনাল হ্যাজার্ড’।

আরও পড়ুন
মৃত পরিচয়ে বেঁচে ছিলেন ৪০ বছর, বিশ্বযুদ্ধের ‘পলাতক’ গুপ্তচরের কাহিনি

যদি সেটা মেনেও নেওয়া যায়, তাহলে শরীরের ভিতরে যে বিষকে তারা রোজ গ্রহণ করছে, তার জন্য কী যুক্তি তৈরি করা যায়? টিএনটি আর কোর্ডাইটের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে ছিল নিত্য সংসার। কোর্ডাইট দিয়ে তৈরি বুলেট চালানোর পর সমস্ত জায়গাটা ঢেকে যেত ধোঁয়ায়। সালফিউরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিড নির্গত হত এইসব পদার্থ থেকে। যার বিক্রিয়ায় কর্মরতা মহিলাদের শরীর আর চুলে পড়ত হলদে ছাপ। ক্রমে যাদের নামই হয়ে যায় ‘হলদে কন্যা’। প্রথমে বোঝা না গেলেও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ত এগুলি। ত্বকের বিভিন্ন রোগে নিত্য আক্রান্ত হতেন তাঁরা। ভিতরে বাসা বাঁধত জন্ডিস। লিভারের রোগে মৃত্যু ঘটেছিল বহু মহিলার। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মকে পর্যন্ত বহন করতে হয়েছে এই ‘হলুদ রোগ’। কয়েকজন মহিলার সদ্যোজাত সন্তানের গায়ের রং-ও ছিল পীতাভ। যাদের বলা হত ‘হলদে শিশু’ (Canary Babies)

আরও পড়ুন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভারতীয় সৈন্যদল এবং নরিমান কারকারিয়ার কিস্‌সা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চার হাজারটি কারখানায় প্রায় দশ লক্ষ মহিলা জড়িয়ে ছিলেন অস্ত্র তৈরির কাজে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মচারী ছিল দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডের এইচএম কারখানায়। ১২০০০ মহিলা শ্রমিক কাজ করতেন এখানে। এ তো গেল শুধু অস্ত্র প্রস্তুতিতে। আরো কয়েক লক্ষ নারী যুক্ত ছিলেন রণাঙ্গনে, আহত সেনাদের চিকিৎসায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা, গুপ্ততথ্য আদানপ্রদানের কাজে। সেই সময়ে পর্যাপ্ত সম্মান না পেলেও পরবর্তীতে কিন্তু বহুভাবে চর্চিত হয়েছে তাদের বীরত্বের কাহিনি। সবচেয়ে বড়ো কথা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই শ্রমজীবী মহিলারা পেয়েছিলেন ‘স্বাধীনতা’-র স্বাদ। যুদ্ধ ঠিক না ভুল, সে বিতর্ক আলাদা; তবে প্রচলিত ‘মেন অ্যাট ওয়ার’-এর সংজ্ঞা বদলে দিতে পেরেছিলেন তারা। 

Powered by Froala Editor